বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ যুব সমাজ। যা প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ। এরমধ্যে ৫৯ শতাংশ যুব নারী ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ের মতো পারিবারিক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছেন। যুব সমাজের ২৭ শতাংশ কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত নেই। ফলে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে যুবদের শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করলেই সারাদেশে বেকারত্ব কমে যাবে।
দেশে কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে চার শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের যুব শ্রমশক্তি ধরে বিবিএস।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। দুই থেকে আড়াই লাখ যুব দেশের বাজারে নিজেদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারছেন। অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে প্রতি বছর গড়ে আট থেকে দশ লাখ যুবসমাজের কাজের সুযোগ পায়। অন্যরা অপ্রচলিত খাতে কাজ করেন। অনেকের হয়তো শেষ পর্যন্ত কাজের সুযোগই থাকে না। এজন্যই ২০১৭ সালে দেশে যুব নীতিমালা হয়। যুব নীতিমালায় যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধি আর তাদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনি দেশের শাসনব্যবস্থায় রাজনীতি ও সরকারি কার্যক্রম পরিচালনায় যুবদের অংশগ্রহণকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়, জেলা এবং জাতীয় পর্যায়েও যুবদের এই অংশগ্রহণ নিয়ে নীতিমালায় বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীন সারা দেশের যুবদের বিভিন্নভাবে দক্ষতা বৃদ্ধির বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ যুব সমাজের সব স্তরের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এসব প্রশিক্ষণ পরিচালনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সরকার প্রতি অর্থবছরেই যুবদের জন্য বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বর্তমানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ প্রায় ৩২০ কোটি টাকার মতো। ২০২০ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হতে আমাদের যুবসমাজকে আরও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।
বিশ্বব্যাংকের একটি তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ বিদেশে আছে। তাদের বার্ষিক আয় ১৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ভারত, ফিলিপাইনের সমপরিমাণ জনশক্তি বাংলাদেশের থেকে কয়েক গুণ বেশি আয় করছে। এর প্রধান কারণ হলো; দক্ষ মানব সম্পদ বিদেশে যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের জানা প্রয়োজন, যুবসমাজ যে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, সেটা কি আদৌ আন্তর্জাতিক মানের? প্রশিক্ষণ থেকে তারা কি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে? দেশে যুবদের জন্য যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেটা কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানের নয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই যুব সমাজের অংশগ্রহণ আছে, সেখানে তারা যেন তাদের সেরাটা দিতে পারে, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের যুবসমাজ শুধু পিছিয়ে পড়ে মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাবে। ফলে প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গুরুত্বসহকারে যুবদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ দিতে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক কর্মবাজারেও সফলতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে।
যুবসমাজই ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্বে আসবে। অর্থনীতির মূল পরিবর্তন আসবে যুবদের হাত ধরে। তাই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যুবদের উন্নয়ন কাজের সমন্বয় করা প্রয়োজন। এক কথায়-সরকারের জবাবদিহিতামূলক জনসেবাই পারে যুব বেকারত্ব দূর করতে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের জন্য যুবকদের জড়িত করা প্রয়োজন। যুবদের বেকারত্ব দূরীকরণে বিশেষজ্ঞদের কয়েকটি অভিমত হচ্ছে: ১. সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা যুক্ত করতে হবে। ২. যুবদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা পাঠ্যক্রমে যুক্ত করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। ৩. প্রশাসনিক কাজ গতিশীল করার জন্য যুব বিভাগ গঠন করা প্রয়োজন। ৪. পলিটেকনিক থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৫. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে। সেচ্ছাসেবক যুব সংগঠনকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। ৬. যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনেক বেশি বাস্তব সম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ৭. বাজেটে যুবদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ৮. যুবদের সঙ্গে পরামর্শ করে যুব বাজেটে ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করা জরুরি। ৯. যুবসমাজের জন্য আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। ১০. যুবসমাজ কীভাবে উদ্যোক্তা হতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। ১১. সামান্য একটা লাইসেন্সের জন্যও যুবদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। তাই যুবদের জন্য ওয়ান স্টপ সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। ১২. নতুন যুব ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে করে যে কোন দক্ষ যুব উদ্যোক্তার সহজ শর্তে ঋণ পায় এবং সুদের হার ৪ শতাংশের নিচে থাকবে। ১৩. প্রতিটি উপজেলা অথবা ইউনিয়নে যুববান্ধব আইটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৪. মাদকাসক্ত যুবকদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি বিশেষায়িত কেন্দ্রীয় হাসপাতাল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৫. বৈদেশিক কর্মসংস্থানে ইচ্ছুক তরুণদের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে একটি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ও ঋণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৬. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের জন্য যুবকদের জড়িত করা প্রয়োজন। ১৭. নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলদেশ শ্রমশক্তির জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ২৩.৪ মিলিয়ন তরুণ-তরুণী (বয়স সীমা ১৫ থেকে ২৯) জাতীয় শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করে। যাদের তাদের অংশগ্রহণ বেড়ে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছাবে এবং এ ধারা ২০৫০ সাল পর্যন্ত চলবে। এটা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল সুযোগ তৈরি করবে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্যদক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৌশলগত বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।
এসডিজির ৮ নম্বর লক্ষ্যটি হলো শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক উন্নতি। এ লক্ষ্যের অধীনে ২০২০ সালের মধ্যে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। আইএলওর প্রকাশিত ২০১৬-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ সালে আগের বছরের তুলনায় বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার কমেছে। ২০১৬ সালেও কর্মসংস্থান কমার আভাস দিয়েছে তারা। আইএলও বলছে, পরের তিন বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল পর্যন্ত শ্রমবাজার ও চাকরির বাজার বাংলাদেশের পাশাপাশি সারা বিশ্বে সংকুচিত হবে। তাদের হিসাবে ২০১৬ সালে কর্মসংস্থান কমবে ৪ দশমিক ২ শতাংশ হারে। এছাড়া ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কমছে ৪ শতাংশ হারে।
বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে বেসরকারি খাতে অধিক হারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সমস্যা দূর করতে হবে। বাংলাদেশে যুবদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হলো- তথ্য প্রযুক্তি, কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, পোশাক শিল্প, পর্যটন ও হালকা কারিগরি নির্মাণ খাত। বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যই প্রয়োজন। অঞ্চলভিত্তিক ইকোনমিক জোন প্রতিটি অঞ্চলের সুষম উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে সহায়ক হবে। শিল্প কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
সরকারের পদক্ষেপ থাকলেও বাস্তবে এ সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বেকার ছেলে-মেয়ে রয়েছে, সে পরিমাণ কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। এটি আমাদের জন্য বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব দূর করতে হলে সর্বপ্রথম পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান সরকার এই বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে দিচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেখানেও দুর্নীতি। পড়ালেখা শেষ করে যদি একজন শিক্ষিত ছেলে তার যোগ্যতানুসারে একটি চাকরি না পায়, তবে সে ছেলেটি দেশের জন্য বোঝা হবে তো বটেই, অনেক সময় দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়েও দাঁড়াবে।
দেশের প্রতিটি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে বেকার যুবকদের। কর্মহীন ব্যক্তিরাই সমাজের ক্ষতি করছে। প্রশাসন ও সরকারকে বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে। সরকার ও একশনএইড বাংলাদেশের পাশাপাশি যুব সমাজকে বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন