হঠাৎ মর্টারের একটা গোলা বিস্ফোরণ, খুব কাছেই, বিকট শব্দ। প্রচন্ড শব্দে কানে তালা লেগে গেল এক যোদ্ধার। বিস্ফোরিত গোলার শক-ফ্রন্টের পিছু পিছু ছুটে এল স্পিন্টারের বৃষ্টি। অনুভব করলেন বীরের ডান পাশটা যেন অবশ হয়ে আসছে। বিশ্বাসঘাতক মর্টারের স্পি্লন্টার সাহসী যোদ্ধার কাঁধে আর হাঁটুতে গভীরভাবে গেঁথে গেল, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে এক অকুতোভয় সাহসী বীর যোদ্ধার। তাতে কি? দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার যে অভিপ্রায়, একটি স্বাধীন মানচিত্র যার কল্পণায়, তাকেতো পিছপা হলে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে। শত্রুকে পরাস্ত করতেই হবে। সঙ্গীদের বাঁচাতে হবে। অস্ত্র বাঁচাতে হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে। প্রচুর রক্তক্ষরণ তবুও শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এমনই এক লোমহর্ষক ঘটনার নায়ক হলেন নূর মোহাম্মদ শেখ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাঁদের অন্যতম।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ সালে, যশোর জেলার অর্ন্তঃগত নড়াইল মহকুমার মহিষখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই বাবা আমানত শেখ ও মা জেন্নাতুন নেসাকে হারিয়ে অনেকটা সংসার বিরাগী জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। সংসারের প্রতি মন ফিরিয়ে আনতে অবিভাবকরা তাঁকে ১৯৫২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করান। স্ত্রী তোতা বিবির বয়স তখন ১২ বছর। ১৯৫৪ সালের শেষভাগে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন। পরবর্তীতে সংসারের হাল ধরতে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯, তদানিন্তন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)-এ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর ইপিআর ক্রমিক নম্বর ছিল ৯৪৫৯। ১৫ নভেম্বর ১৯৬৪, জন্মগ্রহণ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান শেখ মোঃ গোলাম মোস্তফা কামাল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে দিনাজপুর সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় নূর মোহাম্মদ আহত হন। যুদ্ধ শেষে তিনি ‘তকমা-ই-জং’ ও ‘সিতারা-ই-হারব’ মেডেল লাভ করেন।
১৯৭০ সালের ১০ জুলাই নূর মোহাম্মদকে দিনাজপুর থেকে যশোর সেক্টরে বদলি করা হয়। এরপর তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি ছুটিতে গ্রামের বাড়ি আসেন। পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর-এর ৪নং উইং এ নিজ কোম্পানির সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেক্টর গঠন হলে তার উপর ন্যস্ত হয় ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব। তিনি নিয়োগ পান বয়রা সাব-সেক্টরে। এই সাব-সেক্টরের অধীনে গোয়ালহাটি, ছুটিপুরঘাট, সুতিপুর সেনাক্যাম্প, বরনী আক্রমণে অংশ নেন এবং বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বরনীতে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার জীবন রক্ষা করেছিলেন তিনি। সুতিপুর গোয়ালহাটি গ্রামের সামনে স্থায়ী টহল স্থাপন করেন, যা নিজেদের রক্ষার্থে অনেক প্রয়োজন ছিল। সুতিপুর গ্রামটা যশোর সেনানিবাসের কাছেই, কিন্তু ভারত সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় স্ট্র্যাটিজিক্যালি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বরাবরই মুক্তিবাহিনী গ্রামটাকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে দখলে রেখেছে, আর শুরু থেকেই পাকিস্তানিরা সুতিপুর দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এর আগে বেশ কয়েকবার পাকিস্তানিরা সুতিপুর দখল করতে এসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ফিরেও গেছে। সুতিপুরে মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সে শত্রু যেন সরাসরি আক্রমণ করে বসতে না পারে, সে জন্যই সুতিপুরের সামনে গোয়ালহাটিতে মুক্তিসেনাদের একটা টহলদল (স্ট্যান্ডিং পেট্রোল) অবস্থান নিয়ে শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখত।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। আগে থেকেই সুতিপুর ঘাটিতে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণের নতুন পরিকল্পনায় ব্যস্ত পাক বাহিনী। তাই দুইজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে দৃঢ় বলয়ে পাহারা দিচ্ছেন নূর মোহাম্মদ শেখ। সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা, পাকবাহিনী মুহূর্তেই তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে নূর মোহাম্মদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। প্রচন্ড রকমের গুলি বর্ষণ করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে হানাদার বাহিনী। দুঃখের বিষয় হলো, পাক বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে ছিল মাত্র একটি এলএমজি আর দুইটি রাইফেল। অ্যামো প্রায় শেষের পথে। শুধুমাত্র তিনজন মুক্তিযোদ্ধা আর এত সামান্য অস্ত্র দিয়ে হানাদারদের প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। তাই নূর মোহাম্মদ শেখ চিন্তা করলেন, প্রতিরোধ ব্যতিত পিছু হটলে হানাদাররা অতিদ্রুত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে। তাই যতক্ষণ সম্ভব প্রতিরোধ করতেই হবে। এতে মূল ক্যাম্পের যোদ্ধারা নিজেদের প্রস্তুত করতে কিছুটা সময় পাবে। এদিকে পাক সেনারা অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া গুলিতে আহত হন। কোনকিছু চিন্তা না করেই নূর মোহাম্মমদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নিলেন এবং হাতে তুলে নিলেন নান্নু মিয়ার হাতের এলএমজি। শুরু করলেন গুলি চালানো। এককাঁধে নান্নু মিয়া অন্য হাতে এলএমজি, দুর্বার গতিতে গুলি চালাতে থাকলে পাকবাহিনী অনেকটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। যেহেতু তিনদিক থেকেই ঘিরে ফেলেছে তাই এক পয়েন্ট থেকে গুলি করলে অন্য দিকের হানাদাররা অগ্রসর হতে পারে। তাই নূর মোহাম্মদ একবার এক পয়েন্ট থেকে তো আবার অন্য পয়েন্ট থেকে গুলি চালাতে থাকেন। পাক বাহিনী দ্বিধায় পড়ে যায়। মুক্তি সদস্য সংখ্যায় বেশি হতে পারে ভেবে গুলি করা কমিয়ে দেয়। পরিবেশটা স্তম্ভিত হয়ে পরলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না নূর মোহাম্মদ। নান্নু মিয়োকে নিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। এই সময়েই আচমকা মর্টারের শেল তাঁকে আঘাত করে। শেলের স্পিন্টারের আঘাতে হাঁটু প্রায় ভেঙ্গে গেলো, কাঁধে বিরাট এক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সহযোদ্ধা সিপাহী মোস্তফা কামালকে এলএমজিটা তুলে দিলেন। এসএলআর চেয়ে নিলেন নিজের জন্য কারণ নূর মোহাম্মদ জানেন, অলৌকিক কোন কিছু না হলে মৃত্যু অনিবার্য, তার মৃত্যুর পর এলএমজিটা পাকদের হাতে পড়–ক তা তিনি চাননা।
নূর মোহাম্মদ শেখ বললেন, ‘মোস্তফা কামাল তুমি নান্নু মিয়াকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ো। আমি শত্রু পক্ষকে যতটা পারি দমিয়ে রাখবো।’ মোস্তফা কামাল বাকরুদ্ধ। ‘আপনাকে রেখে কেমনে যাই?’
সিপাহি মোস্তফার কাঁধে ঝুলতে থাকা সিপাহি নান্নু মিয়া কঁকিয়ে উঠলেন, গাছের শিকড় আঁকড়ে বসে থাকা মুমূর্ষু ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ শেষবারের মতো কমান্ডারসুলভ নির্দেশে ওদের চলে যেতে বললেন। ‘আল্লাহর দোহাই মোস্তফা, ভালো করে শুনো। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, যেভাবে জখম হয়েছি তাতে আমার বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেভাবে রক্তপাত হচ্ছে, তাতে এখনই আমার শরীর ঝিমঝিম করছে, চোখেও ঝাপসা দেখছি। এমতাবস্তায় আমাকেও নিতে গেলে তোমরা দুজনও মারা যাবে। তিন জন মরে যাওয়ার চেয়ে দুজন বেঁচে থাকা কি ভালো নয়? দেশের স্বাধীনতাকে আনার জন্য তোমাদের বাঁচতে হবে। আমি বলছি তোমরা সরে যাও।’ মোস্তফা কামাল সরে যেতে থাকলেন। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আহত নান্নুকে কাঁধে নিয়ে সিপাহি মোস্তফা ত্রস্ত পায়ে সুতিপুরের মেইন ক্যাম্পের দিকে এগোতে থাকেন।
মোস্তফারা চলে যেতেই নূর মোহাম্মদ তার আহত হাত আর হাঁটু নিয়ে হিঁচড়ে নিজেকে একটু উঁচু করলেন, তারপর শত্রুর দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে ফের নিচু হলেন। গুলিতে কাউকে হতাহত করতে পারলেন কিনা, তা নিয়ে এখন আর কোনো ভাবনা নেই তার। একমাত্র লক্ষ্য যতক্ষণ পারা যায় পাকিস্তানিদের কনফিউজড করে আটকে রাখা, যেন মোস্তফা আর নান্নু তার ফায়ারের কাভারে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পারেন। নূর মোহাম্মদ আহতাবস্তায় আবারো গুলি চালাতে শুরু করেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। প্রচন্ড রক্তপাতের ফলে একসময় শরীরটাকে বাংলার মাটি আলিঙ্গন করলো। বীরের রক্তে শিহরিত হলো সিক্ত হলো মাতৃভূমির মাটি।
ঘন্টাখানেক পর সহযোদ্ধারা ফিরে এসে আক্রমণ করতে থাকে। এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল যে পাক বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হলো। সহযোদ্ধারা একটা ঝোপের মধ্যে নূর মোহাম্মদকে আবিস্কার করলেন। লক্ষ্য করে দেখলেন, যে চোখ দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই চোখ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে, মৃতদেহ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে। হায়েনারা মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি সমূলে ধ্বংস করতে না পেরে, রাগের বহি:প্রকাশ হিসেবে এমনটা করেছে। নূর মোহাম্মদের লাল তাজা রক্তে ভিজে উঠেছে মাতৃভূমির মাটি। সবুজের মাঝে লাল বলয়ে তৈরি করেছে স্বাধীনতার পতাকা। মাত্র ৩৫ বছর ৬ মাস ১০দিন বয়সের বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ শার্শা থানার কাশিমপুর গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেও, তার চির অম্লান চেতনা, দেশের প্রতি মমত্ববোধ, বীরত্বে আজীবন মূর্ত হয়ে থাকবে বিশ্ববাসীর কাছে।
লেখক: শিক্ষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন