দৈনন্দিন বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে রাস্তা-ঘাটে চলাচল করতে হয়। মানুষের এই চলার পথ নিরাপদ, নিষ্কণ্টক ও শান্তিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। সেই সাথে পথচারীকেও সজাগ ও সচেতন হ’তে হয়। পথে বা রাস্তায় চলাফেরার সময় বিভিন্ন নিয়ম-কানূন মেনে চলার জন্য ইসলামে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলো মেনে চললে পার্থিব জীবনে যেমন বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, তেমনি পরকালেও অশেষ ছওয়াব লাভ করা যাবে।
রাস্তার পরিধি
পৃথিবীতে পথ বা রাস্তা মানুষের জন্য আবশ্যকীয় বিষয়গুলির অন্যতম। পার্থিব প্রয়োজনে মানুষকে বাড়ীতে প্রবেশ ও বের হওয়া, বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ইত্যাদি কারণে রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। মানুষের চলাচলের এই রাস্তাকে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও নিষ্কণ্টক করাই ইসলামের নির্দেশ। কিন্তু কোন কোন মানুষ এই পথ বা রাস্তাকে বন্ধ করে দিয়ে অন্যকে বিপদে ফেলে, যা ইসলামে বৈধ নয়। এই রাস্তার পরিধি বা প্রশস্ততা সম্পর্কে ইসলামে নির্দেশনা রয়েছে। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, ‘যখন মালিকেরা রাস্তার ব্যাপারে পরস্পরে বিবাদ করল, তখন নবী করীম (ছাঃ) রাস্তার জন্য সাত হাত জমি ছেড়ে দেয়ার ফায়ছালা দেন’। এই প্রশস্ততা এজন্য যে, যাতে সেখানে যানবাহন প্রবেশ ও বের হ’তে কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয়। এমনকি ঐ রাস্তা ব্যবহারকারীরা যাতে তাদের প্রয়োজনীয় মালপত্রও সহজে আনা নেওয়া করতে পারে।
রাস্তার আদব দ্বারা উদ্দেশ্য
রাস্তা বা পথের আদব বলতে এমন কিছু কাজকে বুঝানো হয়, যা পথচারী, রাস্তা বা পথে উপবেশনকারী ও অবস্থানকারীর জন্য পালন করা যরূরী। আর কারো পক্ষে তা পালন করা সম্ভব না হ’লেও যেন তার প্রতি সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখে। এ সম্পর্কে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা রাস্তার উপর বসা থেকে বিরত থাক। লোকজন বলল, এছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। কেননা এটাই আমাদের উঠা-বসার জায়গা এবং এখানে আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক আদায় করবে। তারা বলল, রাস্তার হক্ব কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি অবনমিত রাখা, কষ্ট দেয়া হ’তে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করা’।
রাস্তার আদব সমূহ
রাস্তার হক বা আদবসমূহ পালনে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। এগুলি প্রতিপালনের ফযীলত ও ছওয়াবও বর্ণিত হয়েছে। যেমনÑ
১. নম্রভাবে চলাচল করা : রাস্তায় চলার সময় গর্ব-অহংকার প্রকাশ পায় এমনভাবে চলাচল করা মুমিনের জন্য সমীচীন নয়। কেননা অহংকার আল্লাহর বৈশিষ্ট্য, যা হরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আর মুমিনকে নম্রভাবে রাস্তায় চলার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে।
২. দৃষ্টি নিম্নগামী রাখা : দৃষ্টি নিম্নগামী রাখার অর্থ হচ্ছে মুমিন নারী-পুরুষের লজ্জাস্থান, যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয় এবং যার দিকে তাকালে ফিৎনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এমন বস্ত্তর দিকে না তাকানো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে’ (নূর ২৪/৩০-৩১)।
দৃষ্টি অবনমিত রাখাকে রাসূল (ছাঃ) রাস্তার হক বা আদব হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যাতে মুমিন অপসন্দনীয় জিনিসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া থেকে বিরত থাকে অন্য মুমিনের সম্মানের দিকে লক্ষ্য করে। বিশেষত বর্তমানে যেভাবে নারীরা বেপর্দায় চলাফেরা করে, তাতে পুরুষদের ফিৎনায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। তাই দৃষ্টি নিম্নগামী রাখা যরূরী।
৩. মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা : মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যেসব কথা-কাজে কোন কল্যাণ নেই সেগুলো থেকে বিরত থাকা। অনুরূপভাবে পথচারীদের কষ্ট দেয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, তাদের গীবত করা অথবা অনুরূপ কষ্টদায়ক কথা ও কাজ পরিহার করা। তাছাড়া পথচারীদের চলাচলে কষ্ট হয় এমনভাবে রাস্তা সংকীর্ণ করে না বসা, কারো বাড়ীতে যাতায়াতের পথে না বসা, কারো বাড়ীর পার্শ্ববর্তী রাস্তায় এমনভাবে না বসা যাতে বাড়ীর লোকজনের ইয্যত-আব্রু রক্ষায় সমস্যা হয়।
৪. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরানো : রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত অপসারণ করতে ইসলাম উৎসাহিত করেছে এবং একে ঈমানের শাখা বলে অভিহিত করেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরটির অধিক শাখা রয়েছে। অথবা ষাটটিরও অধিক। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত ইলাহ নেই। আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে- রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা।
রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম জান্নাতে একটি গাছের নীচে স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটছে। সে এমন একটি গাছ রাস্তার মধ্য থেকে কেটে ফেলে দিয়েছিল যা মানুষকে কষ্ট দিত’।[১১]
৫. পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া : রাস্তার আরেকটি আদব হচ্ছে সকল মুসলমানকে সালাম দেওয়া। আর রাসূল (ছাঃ) ব্যাপকভাবে সালামের প্রসার ঘটাতে বলেছেন। আর এটাকে মানুষের পারস্পরিক মহববত বৃদ্ধির উপায় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না ঈমানদার হবে। আর তোমরা ঈমানদার হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না পরস্পর ভালোবাসা স্থাপন করবে। আমি কি এমন একটি কাজের কথা তোমাদেরকে বলে দিব না, যখন তোমরা তা করবে, পরস্পর ভালোবাসা স্থাপিত হবে? তোমরা একে অপরের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও’।
সালাম প্রদানের নিয়ম সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আরোহী পদচারীকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘বয়োকনিষ্ঠ বয়োজ্যেষ্ঠকে, পথচারী উপবিষ্টকে এবং অল্প সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম দিবে’।[১৫]
৬. সকলের সালামের উত্তর দেওয়া : রাস্তার আরেকটি আদব হচ্ছে সালামের উত্তর দেওয়া। আর কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দেওয়া ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন ‘আর যখন তোমরা সম্ভাষণ প্রাপ্ত হও, তখন তার চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ প্রদান কর অথবা ওটাই প্রত্যুত্তর কর’ (নিসা ৪/৮৬)।
৭. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা : সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপরে আবশ্যক। আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নৈকট্য হাছিল, মানবতার কল্যাণ সাধন এবং শরী‘আত সম্মত যাবতীয় কাজের প্রতি মানুষকে আহবান জানানো সৎকাজের আদেশের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম যা শরী‘আতে নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় কাজ থেকে মানুষকে বাধা দেওয়া বা বিরত রাখার চেষ্টা করা অসৎকাজের নিষেধের অন্তর্গত। এসব কাজ মুমিনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন।
৮. পথ প্রদর্শন করা : পথ দেখিয়ে দেয়া রাস্তার একটি আদব, যা অতি ছওয়াবের কাজ। যাকে ছাদাক্বার সাথে তুলনা করা হয়েছে। পথ দেখানো বিভিন্নভাবে হ’তে পারে। যেমন-
ক. সাধারণ পথিককে পথ দেখানো : যারা গন্তব্যে পৌঁছার পথ চেনে না, তাদেরকে সহজ ও সঠিক পথ বাতলে দেওয়া মুমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে ইসলাম উৎসাহিত করেছে এবং এর অনেক ফযীলত রয়েছে।
খ. পথহারাকে পথ দেখানো : মানুষ উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পথ হারিয়ে ফেললে সীমাহীন বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়। এ অবস্থা থেকে তাকে উত্তরণের জন্য সঠিক পথ বাতলে দেওয়া যরূরী। পথহারাকে পথ প্রদর্শনের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘পথহারা লোককে পথের সন্ধান দেয়া তোমার জন্য ছাদাক্বাহ’।
গ. অন্ধকে পথ চলতে সাহায্য করা : পথ চলার ক্ষেত্রে অন্ধ ব্যক্তির ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কখনও তাকে হাত ধরে তার সাথে চলে তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা। এটা একটি বড় শিষ্টাচার। যার প্রতি ইসলাম উৎসাহিত করেছে। পক্ষান্তরে অন্ধকে ভুল পথ প্রদর্শন করা হ’তে ইসলাম সাবধান করেছে এবং একে অভিশাপে পতিত হওয়ার কারণ বলে আখ্যায়িত করেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে অভিশাপ করেন যে অন্ধকে ভুল পথ দেখায়’।[২৫]
৯. বোঝা বহনকারীকে সাহায্য করা : রাস্তায় উপবেশনকারী বা পথিক অন্যকে তার বোঝা বহনে বা মাথায় উঠাতে অপারগ দেখলে তাকে সাহায্য করবে। এটা রাস্তার অন্যতম আদব।
১০. উত্তম কথা বলা : পথচারী ও অন্যদের সাথে উত্তম ও শালীন কথাবার্তা বলা রাস্তার অন্যতম শিষ্টাচার। যার প্রতি ইসলাম বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ বলেন, (হে নবী!) তুমি আমার বান্দাদের বল, তারা যেন (পরস্পরে) উত্তম কথা বলে। (কেননা) শয়তান সর্বদা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়। এটা সর্বসাধারণের জন্য পালনীয় আদব।
১১. মাযলূম বা অত্যাচারিতকে সাহায্য করা : রাস্তার অন্যতম আদব হচ্ছে অত্যাচারিতকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। সম্ভব হ’লে বল প্রয়োগে, নতুবা মুখের মাধ্যমে সাহায্য করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে যালিম হোক অথবা মাযলূম’।
১২. মহিলাদের রাস্তার পার্শ্ব দিয়ে চলা : রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে মহিলাদের উচিত নিজেদের ইয্যত-আব্রু বজায় রাখার জন্য এক পার্শ্ব দিয়ে চলাচল করার চেষ্টা করা। যাতে পুরুষের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে না যায়।
১৩. বাহন দ্রুত চালনা না করা : যানবাহনে মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ বিভিন্ন ধরনের যাত্রী থাকে। ফলে যানবাহন দ্রুত চালালে তাদের কষ্ট হয়। আবার এতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা হয়। তাই যানবাহন আস্তে-ধীরে চালাতে হবে। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একবার উম্মু সুলাইম সফরের সামগ্রীবাহী উটে সওয়ার ছিলেন। আর নবী করীম (ছাঃ)-এর গোলাম আন্জাশা উটগুলোকে দ্রুত হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন নবী করীম (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘ওহে আনজাশা! তুমি কাঁচের পাত্র বহনকারী উটগুলো আস্তে আস্তে হাঁকাও’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন