রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ভ্রাতৃত্বের পরিচয়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৫:৫৫ পিএম

الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ اِنَّمَا মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। (সূরা হুজুরাত)


একজন মুমিনের নিকট ঈমানের চেয়ে বড় দৌলত আর কিছুই নেই। থাকতেও পারে না। ঈমান তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। মুমিন এমনই হয়। যে ঈমান তার কাছে এতটা প্রিয়, এতটা মর্যাদার, সেই ঈমান যখন তার মতোই আরেকজন মানুষ ধারণ করে তখন তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি অনিবার্য। এটা ঈমানের ভ্রাতৃত্ব। দেশ-কাল-ভাষা-বর্ণের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এ ভ্রাতৃত্ব ছড়িয়ে পড়ে দূর-বহুদূর। কোনো পূর্বপরিচয় নেই, একজন আরেকজনের ভাষাও বোঝে না- এমন দুইজন মুমিনও যখন ঈমানের দাবিতে একত্রিত হয়, তখন মুহূর্তেই যেন তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে হৃদ্যতা। ভাষার সীমাবদ্ধতা, দেশের ভিন্নতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই পবিত্র কুরআনের ঘোষণা- الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ اِنَّمَا মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। (সূরা হুজুরাত)
স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা দিয়েছেন, সেই ভ্রাতৃত্বকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব নানাবিধ কারণেই সৃষ্টি হতে পারে। একই দেশের নাগরিক, একই এলাকার বাসিন্দা, একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, একই কর্মক্ষেত্রে কর্মরত ইত্যাদি অনেক কারণেই তা গড়ে ওঠে! তবে যত কিছুই হোক, আল্লাহ পাকের ঘোষণার সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না। ঈমানী এই বন্ধন যে কেবল দুইজন ঈমানদার ব্যক্তির ঈমানের বিন্দুতে একত্রিত হওয়ার ফলে গড়ে ওঠে- বিষয়টি তা নয়। কুরআন ও হাদীসের নানা জায়গায় নানা আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে এ বন্ধনের গুরুত্বের কথা।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যতক্ষণ তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি না হবে, ততক্ষণ তোমরা মুমিনও হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে একটি কাজের কথা বলে দেব, যা করলে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তোমাদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাও। (সহীহ মুসলিম)
এখানে কথা হচ্ছে- নিজে ঈমানদার হতে হলে অন্য মুমিনদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে হবে। এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা গড়ে তোলার একটি পন্থাও নির্দেশ করেছেন- সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাও। আর বাস্তবতা এমনই- পারস্পরিক সালামের বিনিময় যখন হয়, তখন মন থেকে হিংসা-বিদ্বেষ বাতাসের মতোই উড়ে যায়। সালামকে বলা যায় মুমিনের মন জয় করার এক বিশেষ হাতিয়ার।
প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারার আনসারগণ হিজরতকারী মুসলমানদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের যে নমুনা প্রদর্শন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ঘরবাড়ি ফেলে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে শুধুই নিজেদের ঈমান রক্ষার তাগিদে সূদুর মদীনায় যারা হিজরত করেছিলেন, তাদের একেকজনকে মদীনার একেকজন মুসলমানের ভাই বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রিয় নবীজীর হাতে গড়ে ওঠা ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধনকে তারা এতটাই মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা তাদের এ ভাইদেরকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, নিজেদের সম্পদে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ তো নিজের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে কাউকে তালাক দিয়ে নতুন এই ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে চেয়েছেন।
মুমিনদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুলনা করেছেন একটি দেহের সঙ্গে। এক অঙ্গের অসুস্থতায় পুরো দেহই যেমন কাতর হয়ে পড়ে, ঠিক পৃথিবীর এক অঞ্চলের একজন মুসলমানের ব্যথাও অনুভব করতে হবে অন্য সব অঞ্চলের মুসলমানদের। তখনই এই ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা হবে। হাদীস শরীফের ভাষ্য- তুমি মুমিনদের দেখবে- তারা পারস্পরিক দয়া-ভালোবাসা আর মায়া-স্নেহের বিষয়ে একটি দেহের মতো। দেহের এক অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয়, তখন পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। (সহীহ বুখারী) এই হল ভ্রাতৃত্বের নমুনা। মুমিনগণ যেন একটি প্রাচীর, যার একটি ইট আরেকটিকে শক্তি যোগায়। (সহীহ বুখারী)
একটি দেয়ালের সবগুলো ইট মিলেই তা গড়ে ওঠে। প্রতিটি ইটই ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু দেয়ালের অস্তিত্বের জন্যে ইটগুলোর সম্মিলন অপরিহার্য। একটি ইটের উপর স্থাপিত হয় আরেকটি ইট, সেটার উপর আরও একটি। ইট গাঁথা হয় পাশাপাশিও। এভাবেই গড়ে ওঠে একেকটি দেয়াল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একেকটি ইট দিয়ে তৈরি হয় বড় বড় প্রাসাদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ইটের সঙ্গেই মুমিনদের তুলনা করেছেন। ইট যেমন একে অন্যকে সহযোগিতা করে, মুমিনরাও একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়- সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায়। এই সহযোগিতার ওপর ভর করেই গড়ে ওঠে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব, মুমিনদের সমাজ। ভ্রাতৃত্বের এই শিক্ষা ছড়িয়ে আছে মুমিনের পদে পদে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে প্রতিদিনই সে উপস্থিত হয় মসজিদে। ধনী-গরীব আপন-পরের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দৈনিক এভাবে পাঁচবার একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তারা। জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে এই একটি আমলের শিক্ষাই তো যথেষ্ঠ হওয়ার কথা। একই শিক্ষা পাওয়া যায় ঈদের উৎসবে এবং হজে¦র ময়দানে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান গায়ে দুটি সাদা চাদর জড়িয়ে এক প্রভুর আহ্বানে হাজির। সবার লক্ষ্য এক, মুখেও সবার একই উচ্চারণ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...।
ঈমানী এই ভ্রাতৃত্ব কীভাবে রক্ষা করতে হবে, মুমিনের পাশে মুমিনকে কীভাবে দাঁড়াতে হবে- এর কিছু নমুনাও বলে দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। লক্ষ করুন- ঈমানদারদের সঙ্গে একজন মুমিনের সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন সম্পর্ক দেহের সঙ্গে মাথার। ঈমানদারদের দুঃখ-কষ্ট ঠিক সেভাবেই সে অনুভব করে, যেমন মাথা দেহের ব্যথা অনুভব করে। (মুসনাদে আহমাদ)
ঈমানের এ বন্ধনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো দেশ গোত্র ভাষা কিংবা সময়ের সঙ্গে আটকে দেননি। তাঁর নির্দেশনা এসব সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে ছড়িয়ে আছে বহুদূর পর্যন্ত। তাই তো দূর কোনো দেশের কোনো মুসলমান ভাইয়ের কষ্টকর কোনো সংবাদে অন্য মুসলমানগণ ব্যথিত হন। যথাসম্ভব সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। এই ব্যথা এই কষ্ট আর এই সহযোগিতা ঈমানের দাবি।
ভ্রাতৃত্বের এই দাবি মেটাতে গিয়ে মুমিন তার সবটুকু সাধ্য ব্যয় করবে। সময়ের চাহিদা বুঝে সে এগিয়ে আসবে। মুমিনের পাশে মুমিন থাকবেই। কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো প্রয়োজন হলে শুধুই সঙ্গ দিয়ে সে তাকে সহযোগিতা করবে। সঙ্গত কারণেই ভ্রাতৃত্বের এই বন্ধন রক্ষা করার ফযীলতও খুবই ঈর্ষণীয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দেন। (সহীহ বুখারী)
সহযোগিতা বলতে আমরা বুঝি কেবলই বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গÐিকে আরও অনেক বিস্তৃত করে দিয়েছেন। দেখুন- তিনি বলেছেন- তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক কিংবা মজলুম হোক। সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! মজলুমকে তো আমরা সাহায্য করব। কিন্তু জালিমকে কী করে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তাকে তার জুলুম থেকে বাধা দেবে। (সহীহ বুখারী)
এই হাদীসে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. মুমিন সকলেই একে অন্যের ভাই। এই ভ্রাতৃত্ব সর্বাবস্থায়ই সত্য। একজন মুমিন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে কোনো পাপে জড়িয়ে পড়তে পারে, অন্যায়ভাবে কারও ওপর হাত ওঠাতে পারে। এসবই অপরাধ, কিন্তু এতে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বাতিল হয়ে যায় না। তাই তো হাদীসে মজলুমকে যেমন ভাই বলা হচ্ছে, জালিমকেও একইসঙ্গে ভাই বলেই উপস্থাপন করা হচ্ছে।
দুই. জালিমকে তার জুলুম থেকে ফিরিয়ে রাখাটাই তার জন্যে সহযোগিতা। অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়ে সে জাহান্নামের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে ন্যায় ও কল্যাণের পথে তুলে আনাটাই তার জন্যে প্রকৃত সহযোগিতা। হাদীসে এই সহযোগিতার কথাই বলা হচ্ছে- তোমার ভাই যদি জুলুম করে তাহলে তার হাত ধরে তাকে জুলুম থেকে বাধা দাও।
এই তো ভ্রাতৃত্বের পরিচয়। বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবে, সুখে-দুঃখে কাছে থাকবে, অন্যায় করলে কিংবা ভুল পথে চললে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনবে, তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে আল্লাহর কাছে দুআ করবে। ঈমানী ভ্রাতৃত্বের এই দাবিগুলো যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলেই আমরা প্রকৃত ইমানদার।
প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার মানুষের আমল (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত করা হয়। সেদিন আল্লাহ তাআলা এমন সকলকেই ক্ষমা করে দেন, যে তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না। তবে তাকে ছাড়া, যার এবং তার ভাইয়ের মাঝে বিদ্বেষ থাকে। তখন বলা হয়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা পরস্পর মিলে যায়, এই দুইজনকে পিছিয়ে দাও, যতক্ষণ না তারা মিলে যায়। (সহীহ মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করেছেন, আমি কি তোমাদেরকে নামায রোযা আর সদকার চেয়েও উত্তম কোনো কিছুর কথা বলব? তারা বললেন, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন- পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেওয়া। আর পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া তো (দ্বীনকে) নষ্ট করে দেয়া। (সুনানে আবু দাউদ)
মূল কথা হচ্ছে, যে ঈমানকে বুকে ধারণ করে আমরা নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে পরিচিত করছি, সেই ঈমানের দাবিকে পূর্ণ করতে হলে আমাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও সুসংহত করতে হবে, কোথাও বিপরীত কিছু দেখা গেলে তা দূর করে পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হতে হবে। শান্তির সমাজ পেতে চাইলে এই ভ্রাতৃত্বের বিকল্প নেই।
আমিন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন