৪ দিন বয়সের আরিয়ান জন্ডিসে আক্রান্ত। গত ২ দিন ধরে বাচ্চাটার চোখ শরীর হাত পা হলুদ হয়ে গিয়েছে। ও ওর বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। ওর বড় ভাইয়েরও এমনটি হয়েছিল। আরিয়ানের জন্ম ওর নানুর বাড়িতে। বাচ্চাটি ডাক্তারের দেয়া তারিখের দু’দিন আগেই জন্মেছে। ওর বাবা চাকুরি করে সৌদি আরবে। দুর প্রবাসে থেকেও উনি খুব ভয় পেয়েছেন। এই বাচ্চার জন্ডিস খারাপ কিছু নাত? পরীক্ষার পর দেখা গেল ফিজিওলজিকাল জন্ডিস। তেমন কোন চিকিৎসা ছাড়াই ১০ দিনের আগেই তা ভাল হয়ে গেল।
নবজাতকের জন্ডিস কি?
বাচ্চা জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে রক্তে বিলিরুবিন নামাক রঞ্জক বেড়ে গিয়ে চোখ, চামড়া হলুদ বা সবুজাভ হলুদ হয়ে গেলেই তাকে নবজাতকের জন্ডিস বলা যায়।
নবজাতকের জন্ডিস হওয়ার কারণ কি?
১। প্রথম ১০ দিনের মধ্যে জন্ডিস ঃ
ফিজিওলজিকেল (স্বাভাবিক শরীর বৃত্তিয়),
-মায়ের আর বাচ্চার রক্তের গ্রুপে গরমিল থাকলে,
- শরীরে কোন ইনফেকশন হলে,
-অপুষ্ট অবস্থায় শিশু জন্ম নিলে,
-জন্ম থেকেই রক্ত ভেঙে যাওয়া রোগ শরীরে থাকলে,
-জন্মগত এনজাইম সমস্যাগত কারণে ইত্যাদি
২। ১০ দিনের পরও জন্ডিসঃ ২-১টি বাচ্চার মায়ের বুকের দুধ থেকে একধরনের জন্ডিস হয়। এছাড়া ১০ দিনের পর জন্ডিস হলে একটু চিন্তার বিষয়।
তবে উপরের কারণগুলো ছাড়াও লিভারে ইনফেকশন, হরমোন ঘাটতি- বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েড এবং লিভারের বাইরে পিত্ত প্রবাহ আটকে গেলেও এমনটি হতে পারে। তাই ১০ দিনের পরের জন্ডিসকে অবহেলা করা যাবে না কখনওই।
তাড়াতাড়ি জন্ডিস পরীক্ষা দরকার কেন?
- প্রথম দিন থেকেই জন্ডিস,
- যে কোন দিন খুব বেশি জন্ডিস,
- ১০ দিন পর যে কোন জন্ডিস,
- তাড়াতাড়ি বেড়ে যাচ্ছে যে জন্ডিস,
-পিত্ত প্রবাহ আটকে যাওয়াজনিত জন্ডিস ইত্যাদি।
মেনে নিতে হবে ফিজিওলজিকেল জন্ডিস- বড়দের মাত্রায় হিসাব করলে সব নবজাতকই অল্পবিস্তর জন্ডিস আক্রান্ত হয়। বড়দের ২ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারের বেশি হলেই তাকে জন্ডিস আক্ষা দেয়া যায়। আর নবজাতকদের পূর্ণ বয়সি জন্ম হওয়াদের ৬০% এবং অপূর্ণ বয়সে জন্ম হয়ে যাওয়াদের ৮০% স্বাভাবিক এই জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। তবে পূর্ণবয়সিদের ১০ দিনের মধ্যেই তা ভাল হয়ে যায়। তবে এই জন্ডিস ৩ থেকে ৫ দিনের পর আর বাড়ে না। অল্প বাড়লে কোনো কোনো চিকিৎসক বাচ্চাদের সকালের সূর্যের আলোতে দেয়ার উপদেশ দেন। আর একটি নির্দিষ্ট মাত্রার উপরে গেলে চিকিৎসকের তত্ত¡াবধান লাইট দিয়ে ফটোথেরাপি চিকিৎসা দেয়াটাই নিয়ম।
এই জন্ডিসের কোন পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জীবনে আর দেখা যায় না। তাই বলা হয় নবজাতকের এই জন্ডিসে ঘাবড়াবেন না।
কোন জন্ডিস মারাত্মক?
রক্ত কণিকা ভেঙে গিয়ে খুব বেশি মাত্রায় জন্ডিস হলে তা খুবই মারাত্মক। তাই গর্ভবতীদের নিজের এবং তার স্বামীর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে আগেই তা চিকিৎসককে জানিয়ে রাখতে হবে। বিশেষ করে যে মায়েদের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ বা ‘ও’ গ্রুপের।
-হরমোন কমজনিত কারণে জন্ডিস হলে। বিশেষ করে থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে, জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম নামক রোগ হয়। যা দ্রুত চিকিৎসা না করালে বাচ্চার মস্তিষ্কের বৃদ্ধি না ঘটার কারণে বাচ্চা চিরকালের জন্য স্বল্প বুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে।
-মায়ের গর্ভালীন লিভারের প্রদাহ। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি হলে জন্মের সাথে সাথে বাচ্চাকে টিকা দিয়ে রক্ষা করতে হবে।
-পিত্ত প্রবাহ আটকে যাওয়া জন্ডিসও খুব দ্রুত অপারেশনের মাধ্যমে আরোগ্য করতে হবে। অন্যথায় লিভার নষ্ট হয়ে দ্রুতই বাচ্চাটা লিভার নষ্ট হয়ে মারা যায়।
-অন্যান্য জন্মগত/বংশগত কারণে হওয়া জন্ডিসের চিকিৎসাও দ্রুত শুরু করতে হবে, যদি চিকিৎসা দেয়া সম্ভবপর হয়। যদিও এরকমের জন্ডিস খুব কম দেখা যায়।
জন্ডিসের পরীক্ষা যাদের করাতেই হবে
-অপুষ্ট হয়ে জন্ম নিলে,
- গর্ভসময়ের চেয়েও ছোট ওজনের বাচ্চা,
- মাথা ছোট হলে গর্ভকালীন ইনফেকশনের লক্ষণ,
-ফেকাসে বাচ্চা যার রক্ত কণিকা ভেঙে গিয়েছে,
- চামড়ার নীচে রক্তক্ষরণ, মাথার চামড়া, থলথলে, চামড়ায় নীল/কাল দাগ,
- নাভীতে ঘা দেখা গেলে,
- লিভার, প্লিহা বড় হয়ে গেলে,
- থাইরয়েড হরমোন কম পাওয়া গেলে।
নবজাতকের জন্ডিস প্রতিরোধ।
- মায়ের পুষ্টি, বিশ্রাম, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাঁপানী একলাম্পসিয়া ইত্যাদি ঠিক রেখে অপুষ্ট শিশু জন্মদান রোধ করতে হবে।
-বাচ্চাকে পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখবেন এবং হাত না ধুয়ে বাচ্চাকে কেউ ধরবেন না। অন্তত প্রথম ১ মাস।
-বাচ্চাকে শালদুধ দিন এবং শুধুমাত্র বুকের দুধ দিত থাকুন।
-মা হওয়ার আগেই মাকে হেপাইটিস বি -এর টিকা দিন।
- মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ এবং বাবার পজেটিভ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মত এন্টি-ডি নিন।
-মা এন্টিথাইরয়েড ওষুধ খেলে বা হাইপোথাইরয়েড হলে চিকিৎসককে আগেভাগেই তা জানাবেন।
ডা. জহুরুল হক সাগর
নবজাতক ও শিশু কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ
প্রাইম এইড হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার
শনির আখড়া বাসষ্ট্যান্ড, ব্যাংক এশিয়া ভবন
ফোন ঃ ০১৭১৬৮৬৫৩৫৪: ৭৫৪৪৪৪১
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন