শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চীনা প্রস্তাব : গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে আর বিলম্ব নয়

প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পানি সমস্যা বাংলাদেশের জীবন-মরণের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় এ সমস্যার উদ্ভব এবং ক্রমাগত এর প্রকটতা বাড়ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৫৪। এই ৫৪টি নদী থেকেই ভারত কোনো না কোনোভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এসব নদীর মধ্যে এমন কিছু নদীও আছে যাদের কেন্দ্র করে একই সঙ্গে সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়েছে বা হচ্ছে। শুকনো মওসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যায়। পানির অভাবে কৃষি ও শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও নৌ-চলাচল, মৎস্য চাষ ইত্যাদি বিঘিœত হয়। ইতোমধ্যে নদীগুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার বিস্তার ও উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ শুরু হয়েছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এই বিবিধ প্রতিক্রিয়া চলমান। ওদিকে বর্ষা মওসুমে বন্যা ও উজানের বাঁধ খোলা পানি যখন নামে তখন নদীগুলো ভয়াবহ ভাঙনপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং তীরবর্তী জনপদ, বাগ-বাগিচা, শস্যক্ষেত, স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। বলা যায়, ভারতের বৈরী পানিনীতির কারণে বাংলাদেশ একদিকে পানি না পেয়ে মরছে, অন্যদিকে বান-বন্যায় ডুবে মরছে, ভাঙনে মরছে। আন্তর্জাতিক আইন-বিধি অনুসারে ভারত অভিন্ন নদীর উজানে এমন কিছু করতে পারে না যাতে নদীর গতিপথ ও প্রবাহে পরিবর্তন ঘটে এবং বাংলাদেশের ক্ষতি সাধিত হয়। ভারত আন্তর্জাতিক আইন-বিধির তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি করলেও ভারত তাতে কান দিচ্ছে না। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কখনোই পানি পায় না। তিস্তার পানি চুক্তির বিষয়টি হিমঘরে ঠাঁই নিয়েছে। অন্যান্য নদীর পানি বণ্টন নিয়ে তো কোনো কথাই নেই। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক আজ কয়েক বছর ধরে হচ্ছে না। বাংলাদেশের বারবার তাকিদ সত্তে¡ও ভারত বৈঠকের ব্যাপারে নানা ওজর-অজুহাত ও অনীহা দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত হিস্যা পাবে, একথা আর এখন কেউ বিশ্বাস করে না। পর্যবেক্ষকদের মতে, পানি আলোচনার অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং ভারতের আচরিত আচরণের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে পানির মামলা চালিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে পানি সমস্যার সমাধানে সম্ভাব্য সকল বিকল্প কাজে লাগাতে হবে।
পানি সমস্যা এখন কোনো দেশ বা অঞ্চল বিশেষের সমস্যা নয়। এটি একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে। অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেমন বিরোধ লক্ষণীয়, তেমনি একই দেশের এক এলাকার সঙ্গে অন্য এলাকার বিরোধও দেখা যাচ্ছে। পানির চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। উৎপাদন, উন্নয়ন, পান, ব্যবহার প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই এই চাহিদা বাড়ছে। ফলে পানি নিয়ে টানাটানি ও বিরোধও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি হয় তবে হবে পানিবিরোধকে কেন্দ্র করেই। এর আলামত আস্তে আস্তে দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। ভারত পানির ব্যাপারে যে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়নে সে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বর্ষা মওসুমে প্রচুর বৃষ্টি হয় ও উজান থেকে বিপুল পানি নেমে আসে। এই পানির অংশবিশেষও যদি ধরে রাখা যায় তবে শুকনো মওসুমে আগামী বহু বছর পানির কোনো অভাব হবে না। বাঁধ-ব্যারাজ নির্মাণ, নদী সংস্কার ও খাল খননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। যে বিপুলসংখ্যক নদী-খাল-বিল, জলাশয় ও পুকুর রয়েছে সেগুলোকে সহজেই রিজার্ভার করে তোলা যায়। এই পটভূমিতেই বহুকাল আগে পরিকল্পিত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টি বার বার উচ্চারিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেও এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভারতের আপত্তির কারণেই তা ঝুলে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের আপত্তির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে সাথে নিয়ে ব্যারাজ নির্মাণের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্টদের। সে মোতাবেক, ভারতকে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। পরবর্তী যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি সুরাহা করার ইচ্ছা বাংলাদেশের থাকলেও সেই কাক্সিক্ষত বৈঠকটি এখনো হয়নি। ভারতের আপত্তির আসলে যৌক্তিক ভিত্তি নেই। ভারত বলেছে, এই ব্যারাজ নির্মিত হলে উল্টো স্রোতে ভারতে বন্যা ও ভাঙন দেখা দেবে। বাংলাদেশের তরফে বলা হয়েছে, প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরনের কোনো আশঙ্কাই নেই। অথচ ভারত তার কথায় গো ধরে আছে। বলা বহুল্য, ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় পরিকল্পিত গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পে ভারত সম্মতি দেবে, সমর্থন দেবে, সহযোগিতা দেবে, এটা কিভাবে আশা করা যায়! সঙ্গতকারণেই ভারতের দিকে চেয়ে থাকা, তার সম্মতি-সমর্থন-সহযোগিতার আশায় অপেক্ষা করার সুযোগ-অবকাশ নেই। যে প্রকল্পের উদ্বোধন করার কথা ছিল ২০১৪ সালে, তা এখনো বেখবর থাকা দুর্ভাগ্যজনক। ইতোমধ্যেই অবশ্য একটি আশার খবর পাওয়া গেছে। চীন গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে তার গভীর আগ্রহের কথাই জানায়নি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছে। চীনা প্রস্তাবে প্রকল্প ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্প সমীক্ষায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। চীনা প্রস্তাবে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সম্মত হলে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি হতে পারে। আমাদের জানা মতে, এর আগে আরও কয়েকটি দেশ এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রদর্শন করেছে। আমরা মনে করি, জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ অপরিহার্য, জরুরি ভিত্তিতে তা শুরু ও শেষ করা দরকার। ব্যারাজটি নির্মিত হলে ১৬৫টি উপজেলায় সেচ দেয়া সম্ভব হবে। ১৬৫ কিলোমিটার জুড়ে যে রিজার্ভার গড়ে উঠবে যাতে সংশ্লিষ্ট এলাকার নদ-নদীগুলো নাব্য থাকবে। প্রতি বছর অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা আয় হবে। যে কোনো বিবেচনায় পদ্মা সেতুর চেয়ে গঙ্গা ব্যারাজ গুরুত্বপূর্ণ। দেশের আরো ক্ষতি হওয়ার আগেই আমরা আশা করব, প্রকল্পের কাজ দ্রæত শুরু করা হবে। চীনা প্রস্তাব এ ক্ষেত্রে এক বড় অনুপ্রেরণা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Olive Sikder ১৩ জুন, ২০১৬, ১০:৫৮ এএম says : 0
ইনশাআল্লাহ হবেই......
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন