শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

যশোরে মোটর শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গণপরিবহণ হিসেবে ব্যবহৃত গাড়ি নির্মাণে যশোরের ওয়ার্কশপ ও উদ্যোক্তারা নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছেন। গাড়ির বডি নির্মাণের মধ্য দিয়ে সেখানে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে তা ক্রমশ বিস্তার লাভ করে চলেছে। স্টীলবডি, চেসিস, আভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা থেকে শুরু করে লাইটিং, টায়ার রি-রোলিং এবং ইঞ্জিনের অধিকাংশ যন্ত্রাংশ এখন স্থানীয়ভাবেই তৈরী হচ্ছে। কিছুদিন আগেও গাড়্রি ছোটখাট যন্ত্রাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হত, সেখানে বর্তমানে সেই নির্ভরশীলতা কাটিয়ে অনেকটা স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে দেশের অটোমোবাইল শিল্প। ক্রমবর্ধমান চাহিদার উপর ভিত্তি করে দেশের অটোমোবাইল শিল্পে বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্বেও গত ৫দশকেও এ খাতের প্রত্যাশিত বিকাশ ঘটেনি। বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি আমদানীতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। অথচ এ খাতে স্বয়ম্ভরতা অর্জন অসম্ভব ছিল না। এক সময় দেশে গাড়ী নির্মাণে প্রগতি ইন্ডাসট্রিজ সে স্বপ্ন দেখাতে পারলেও সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে তা সফল হয়নি। কোনো একটা মহল এ খাতে দেশকে পরনির্ভরশীল রাখতে চায়, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বহু বছর ধরে জাপান থেকে আমদানিকৃত রিকন্ডিশন্ড গাড়ির মাধ্যমে দেশের প্রাইভেট কারের চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করা হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিতে অনাকাঙ্খিত বিধিনিষেধ, করবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ভারত থেকে নিম্নমানের গাড়ি আমদানির পথ সুগম করা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ভারত থেকে আমদানি করা নিম্নমানের নতুন গাড়ি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অচল হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। তথাপি ভারত থেকে নিম্নমানের গাড়ি আমদানি বন্ধ হয়নি।

অটোমোবাইল শিল্পে পরনির্ভরতায় লাভবান হচ্ছে জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি কারক এবং ভারতীয় গাড়ির দেশিয় এজেন্টরা। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির উপর বাড়তি শর্ত এবং শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ার পেছনে ভারতীয় গাড়ির বাজার সৃষ্টির দূরভিসন্ধির অভিযোগ তুলতেও দেখা গেছে বারভিডাসহ সংশ্লিষ্টদের। বিআরটিসি সহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থার জন্য ভারত থেকে গাড়ি আমদানির কয়েক মাসের মধ্যেই তা বেহাল দশায় পতিত হওয়ার অভিজ্ঞতাও দীর্ঘদিনের। ষাটের দশকে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম অটোমোবাইল কারখানা এ খাতে এক বিশাল সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে এতদিনে দেশের অটোমোবাইল খাতের এক বড় অংশই আভ্যন্তরীণভাবেই যোগান দেয়া সম্ভব হত। ঢাকা ও যশোরে গড়ে ওঠা শত শত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারি ও উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে সে স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপায়িত হতে চলেছে। যদিও এ ধরনের প্রকল্পে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সে সব ছাড়াই যখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা যশোরের ওয়ার্কশপ ও ফাউন্ড্রি কারখানাগুলোতে গাড়ির অধিকাংশ যন্ত্রাংশ তৈরী করতে সক্ষম হচ্ছে, সেখানে সরকারি বিনিয়োগ, প্রণোদনা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে তারা এই শিল্পকে আরো বহুদুর এগিয়ে নিতে পারবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ঢাকা ও যশোরের বডি বিল্ডিং ওয়ার্কশপ ও কারখানাগুলোতে তৈরী করা যন্ত্রাংশে গণপরিবহনের বেশিরভাগ চাহিদা পুরণ করতে সক্ষম হলেও প্রাইভেটকার নির্মানে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে মটর সাইকেল উৎপাদনে বেশ কৃতিত্ব অর্জন করলেও প্রাইভেটকার তৈরীতে তাদের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ জন্য যে ধরণের পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন তা এখনো দেখা যাচ্ছে না। যশোরের উদ্যোক্তারা শুধুমাত্র গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণেই থেমে থাকেনি, তারা ইতিমধ্যে পাথর ভাঙ্গা মেশিন, ইটভাঙ্গা মেশিন, কংক্রীট মিকচার মেশিন, বিটুমিন মিকচার মেশিন, পানির পাম্প ও শ্যালো ইঞ্জিন মেশিনসহ নানা ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরী করে দেশের চাহিদা পুরণ করছে এবং ইতিমধ্যে ভারতেও রফতানি করছে। যশোরের শিল্পোক্তাদের এই সাফল্য দেশের মোটর শিল্পে একটি যুগান্তকারি অগ্রগতি। যশোরের অটোমোবাইল ও মোটর কারখানাগুলোতে বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছে। এসব শ্রমিক, টেকনিশিয়ানদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি বুয়েটসহ দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গাড়ি ও ইঞ্জিনের ডিজাইনসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে মোটর শিল্পে দেশে সত্যিকারের বিপ্লব সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যেন এই সম্ভাবনাকে আর নস্যাৎ করতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বাংলাদেশের শিপইয়ার্ড থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে জাহাজ, ফেরি ও ফ্রিগেটসহ নানা ধরনের নৌযান রফতানি করা হচ্ছে। দেশে গাড়ি নির্মাণে জাপানীদের বিনিয়োগ ও শিল্পোদ্যোগের কথা জানা যায়। জাপানি ও চীনা সহযোগিতায় অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগের পাশাপাশি ঢাকার ধোলাইখাল, যশোরসহ এ খাতে দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলে অটোমোবাইল খাতে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করা খুব কঠিন কিছু নয়। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া সরকারের দায়িত্ব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন