হাফিজ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার
॥ শেষ কিস্তি ॥
সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নেমে আসে স্থবিরতা। এতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা দারুণভাবে ব্যাহত হয়। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস থেকে পরিত্রাণের জন্য পবিত্র কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা এবং নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস বিরোধী আয়াত ও ইসলামের মানবতাবাদী শিক্ষা সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের মূলোৎপাটনের জন্য সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক কাজে অবদান রাখাও প্রয়োজন। বিশেষ করে যুবসমাজের আত্মকর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
নৈতিক শিক্ষা : ইসলামের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিষয় সম্পর্কে দারণা, প্রধান প্রধান নৈতিক সমস্যা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার উৎস সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হয়েছে। পৃথিবীর বিশাল কর্মক্ষেত্রে কাজ করার জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মানুষের আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ইসলামে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মহান নৈতিক গুণাবলী পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি। নৈতিকতা বিচারে যে লোক উত্তম, মুমিনদের মধ্যে সেই পূর্ণতম ঈমানদার।’
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ইসলাম : মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা সবসময় অনৈতিক কাজে জড়িত থাকে। তারা যে শুধু নিজেদের ক্ষতি করে তা নয়, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও তারা ক্ষতিকর। ইসলামে মাদক গ্রহণকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। তবুও কি তোমরা তা থেকে নিবৃত্ত হবে না।’ মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! মদ ও ঈমান একত্র হতে পারে না।’
দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলাম : বর্তমান পৃথিবীতে যে কোনো সমাজের উন্নয়নে দুর্নীতি এক ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মসাৎ, অবৈধ দখল, পরস্ব অপহরণ ইত্যাদির সবই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা ঘটছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। ‘ঘুষ প্রদানকারী ও ঘুষ গ্রহণকারী দু’জনই জাহান্নামে যাবে।’ (তারগীব)
সম্পদ উপার্জন ও ব্যয় : লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে মানুষ অবৈধভাবে অন্যের সম্পত্তি দখল করে। চোরাচালানী, প্রতারণা ও জালিয়াতির সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে এবং আখেরাতের জবাবদিহি চেতনা জাগ্রত করে মানুষকে এসব সমাজ বিরোধি তৎপরতা থেকে বিরত রাখতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম : ১৯৭১-এ বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রম হরণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো জঘণ্য ঘটনা ঘটিয়েছে। এই নারকীয় অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে এদেশের জনগণকে।
স্বাধীনতার জন্য জনগণের এই আত্মত্যাগ আমরা কখনোই ভুলব না। অত্যাচারিত জাতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ জীবন উৎসর্গকারীরা নতুন প্রজন্মকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ (আরবী প্রবাদ)। স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। দেশপ্রেমের উদ্দীপনা হৃদয়ে ধারণ করে এবং যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। অতএব এ স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে এবং দেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
ইসলামে মানবাধিকার : মানবাধিকার ও ইসলাম মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের মধ্যে জীবন ধারনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মের অধিকার, ন্যায়বিচার লাভের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি। এই অধিকার লঙ্ঘিত হলে মানুষের বেঁচে থাকা অর্থহীন ও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা, সৃষ্টি হয় অরাজকতা। এমনিভাবে ক্রমশ নষ্ট হয় দেশের শান্তি, বিশ্বের শান্তি। তাই মানুষের সহজাত অধিকারের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ইসলামের অপব্যাখ্যা রোধ : আল্লাহ ও রাসূল প্রেমিক অগণিত মুবাল্লিগগণের নিষ্ঠার সাথে দ্বীন প্রচারের ফলে বাংলার জমিনে ইসলাম একটি অত্যন্ত শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। বলপ্রয়োগ, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মাধ্যমে অথবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিশ্বের কোথাও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের দেশে একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী, মসজিদকে ইবাদত বন্দেগীর পরিবর্তে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের কেন্দ্রে পরিণত করতে সচেষ্ট রয়েছে। তারা হীন রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য ইসলামের অপব্যাখ্যা করে। তারা সর্বদা দলীয়স্বার্থ ও রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনে মসজিদ ও ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে। তাদের জঘন্য তৎপরতা যাতে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি নষ্ট করতে না পারে সে জন্যে সতর্ক থাকা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রত্যেকের ঈমানী দায়িত্ব। মওদুদীপন্থীদের অপতৎপরতার কারণে অতীতে আমাদের এদেশে উগ্রবাদ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ : মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ধর্মপ্রাণ জনগণ ও হক্কানী আলেম উলামাগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রতিবাদে তা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সন্ত্রাসের মূল হোতারা অবস্থান করে অনেক দূরে। তারা শুধু কিছু উগ্র ধর্মান্ধ ও স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে সুকৌশলে তাদের কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করে থাকে। পরবর্তীকালে এরাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিপীড়িত, স্বল্প শিক্ষিত, নিরক্ষর ও বেকার যুবকদের ধর্মের বিভিন্ন অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্ম রক্ষার নামে তাদের মাধ্যমে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কর্মকা- পরিচালনা করে। এ কাজের জন্য যাদের ব্যবহার করা হয় তারা মূলত সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির নাগরিক। অর্থাভাবে তারা এ ধরনের আত্মঘাতী কাজে যুক্ত হয়। ভ্রান্তিপূর্ণভাবে ধর্মবিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করে তাদেরকে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণে সামাজিক সমস্যার সমাধান : আসুন আমরা পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও নবী করীম (সা)-এর সুন্নাহর অনুসারী হয়ে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নৈরাজ্যমুক্ত মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে শান্তি, সহাবস্থান ও সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন আমীন!
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন