শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে বাসভাড়া!

নৈরাজ্য থামেনি : প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১:৪৪ এএম

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ‘গ্রিন ঢাকা’ বাস। এই বসে উঠলেই গুনতে হয় ৬০ টাকা ভাড়া। অথচ সাধারণ বাসে এই ভাড়া ৪০ টাকা। বিআরটিসির ভাড়া ২০ টাকা।
মিরপুরের আনসার ক্যাম্পের সামনে থেকে গুলশান নতুন বাজার হয়ে চলে আকিক পরিবহনের বাস। এই বাসে উঠলেও যাত্রীদের গুনতে হয় কমপক্ষে ২৫ টাকা। সিটিং সার্ভিস নামের এই বাসে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তোলা হয়। অথচ ভাড়া নেয়া হয় সিটিং হিসাবে। যে কোনো স্থানের জন্য এই বাসের ভাড়া ২৫ টাকা। শনির আখড়া থেকে গুলিস্তানের ভাড়া দূরত্ব হিসাবে ১০ টাকা। অথচ হানিফ ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে এই ভাড়া ১৫ টাকা। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে পাটুরিয়া যেতে সাধারণ বাসে ভাড়া নেয়া হয় ৭০ টাকা। ঈদুল আজহার সময় নেয়া হয়েছে ৩০০ টাকা। ঈদের পর ঢাকামুখি যাত্রীরা সদরঘাট থেকে সুপ্রভাত পরিবহনে উঠলেই গুনতে হয়েছে একশ’ টাকা। রাজধানীর প্রতিটি রুটেই ভাড়া নিয়ে এরকম নৈরাজ্য নিত্যদিনের ঘটনা। অদক্ষ ও বদলি চালক দিয়ে বাস চালানোর কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত ২৭ আগস্ট ট্রাস্ট সার্ভিসের যে বেপরোয়া বাস বাংলামটরের ফুটপাথে বিআইডবিøউটিসির কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায়কে চাপা দিয়েছিল, সেটা চালাচ্ছিল একজন বদলি চালক। পুলিশের কাছে ধরা পড়া মোরশেদ নামের ওই চালক বলেছে, ওই দিনই সে প্রথম স্টিয়ারিং ধরে রাস্তায় নামে।

গত ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের যে বেপরোয়া বাস সঙ্গীতশিল্পী পারভেজ রবকে ফুটপাথ ঘেঁষে চাপা দিয়ে হত্যা করে, সে বাসটিও চালাচ্ছিল ‘বদলি’ চালক। একই দিন মহাখালীতে ক্যান্টনমেন্ট মিনি সার্ভিসের বেপরোয়া বাস বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে ফুটপাথে তুলে হত্যা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারহা নাজকে। এই বাসটি চালাচ্ছিল ১৫-১৬ বছরের এক কিশোর। বছরের প্রথম দিকে গত ১৯ মার্চ রাজধানীর নদ্দায় সুপ্রভাত পরিবহনের যে বাসটি জেব্রা ক্রসিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরারকে চাপা দিয়েছিল, সে বাসটিও চালাচ্ছিলেন বদলি চালক। মালিক সমিতির সিদ্ধান্তের পরে বাস সার্ভিসগুলো আগের মতোই দিন চুক্তিতে চলছে। আর দিন চুক্তির চালকরা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে গাড়ি তুলে দিচ্ছেন বদলি চালকের হাতে। উপরি আয়ের নেশায় বদলি চালকরা যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী তুলছে। পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। এসব বিশৃঙ্খলা টিকিয়ে রেখেই আবারও বাসের ভাড়া বাড়ানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে মালিকপক্ষ। আর বিআরটিএ-এর কতিপয় কর্মকর্তাও তাতে সায় দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ নিয়ে দুই দফা বৈঠকও হয়েছে। এখন বিআরটিএ প্রস্তাব দিলে মন্ত্রণালয় থেকে তা অনুমোদন হবে। সে হিসাবে খুব শিগগিরিই বাস ভাড়া বাড়ছে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসভাড়া কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা, মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারে এক টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে সরকার। বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা, মিনিবাসে পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঢাকা মহানগরী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ ঢাকা জেলার বিভিন্ন রুটে ওই হার কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর দূরপাল্লার বাসভাড়া কিলোমিটারে ১৫ পয়সা বাড়িয়ে এক টাকা ৩৫ পয়সা করা হয়। ২০১৩ সালে দূরপাল্লার বাসভাড়া আবার ১০ পয়সা বাড়িয়ে এক টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়। ডিজেলের দাম কমায় দূরপাল্লার বাসভাড়া ২০১৬ সালে তিন পয়সা কমিয়ে এক টাকা ৪২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। বাস্তবে সরকার নির্ধারিত এসব ভাড়ার হার কখনো মানেনি পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। বিশেষ করে ঢাকা সিটি সার্ভিসে ভাড়া নিয়ে সারা বছরই নৈরাজ্য ছিল, এখনও চলমান।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ঢাকার সিটি সার্ভিসে এখন রুটসংখ্যা ২৮৯। মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী ১৭৬টি রুটে নিয়মিত বাস চলছে। বাকিগুলোতে কখনও বাস চলে, কখনও চলে না। প্রতি রুটে একটি, কোনো কোনো রুটে একটির বেশি পরিবহন কোম্পানির বাস চলছে। কোম্পানি শুধু রুট বরাদ্দ নেয়। আর কোম্পানির ব্যানারে প্রকৃতপক্ষে বাস চালান ব্যক্তি মালিকরাই। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের অশুভ প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে শহীদ রজিম উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হলে পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার হন শুধু বাসের ব্যক্তি মালিক। একইভাবে নদ্দায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার পর সুপ্রভাত পরিবহনের সংশ্নিষ্ট বাসের ব্যক্তি মালিককেই ধরা হয়। মূল কোম্পানির কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান। নৈরাজ্য না থামার এটা একটা বড় কারণ বলে মনে করেন খোদ বাস মালিকরাই।

সাধারণ যাত্রীরা জানান, প্রতি বছরই ঈদ এলে রাজধানীসহ দেশের প্রায় ৪০০ রুটে বাস ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলে। তখন প্রায় প্রতিটি রুটের ভাড়া ৫ গুন বাড়িয়ে দেয়া হয়। ঈদ চলে যাওয়ার পরেও কোনো কোনো রুটের ভাড়া আর কমানো হয় না।

জানা গেছে, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি), টায়ার, টিউবের দাম ও শুল্ক বাড়ার কারণ দেখিয়ে ঢাকাসহ দেশজুড়ে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়াতে সরকারের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে পরিবহন মালিকরা। এ বিষয়ে গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে একটি চিঠি দেয়। এ নিয়ে কিছুদিন আগে বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ে উভয়পক্ষের বৈঠকও হয়েছে।

গত ১ জুলাই থেকে সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা দাবি করছেন, ঢাকা ও আশপাশের রুটগুলোয় ৪০ শতাংশ বাস ও মিনিবাস চলাচল করে সিএনজিতে। এতে বাস ও মিনিবাস পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া ২০১৫ সালের পর আর বাড়ানো হয়নি। চার বছর ধরে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়নি। সে কারণেই তারা বাসের ভাড়া বাড়াতে চাচ্ছেন।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান জানান, পরিবহন মালিকরা গ্যাসের দাম, বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। আমরা বাজার যাচাই করছি। পরিবহন মালিকরাও বাজার যাচাই করছেন। তারপর আমরা পর্যালোচনা করে প্রস্তাব তৈরি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠাব।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন