ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান
॥ তিন ॥
আত্মশুদ্ধি লাভ রোযার মুখ্য উদ্দেশ্য। রমযানের রোযার মাধ্যমে মানুষ তার নফ্সের বৈধ চাহিদা পরিহার করে। আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করে। কুপ্রবৃত্তিকে ত্যাগ করে। নিজের আত্মাকে উত্তম আমলে উদ্যোগী করে। এভাবে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভে এগিয়ে যায়।
রোযা আত্মশুদ্ধি ও সৎগুণাবলীর উন্নতি সাধনের মাস। সৎগুণ সামাজিক পরিবেশকে উন্নত করে। রোযা সততা ও সত্যবাদিতা শিক্ষা দেয়। রোযা আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির দ্বারা মানুষকে ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত করে। ফেরেশতাদের পাশবিক প্রবৃত্তি নেই। কাজেই পরস্পর হানাহানি, ঝগড়া বিবাদ, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা তাদের মধ্যে নেই। প্রকৃত রোযাদার ফেরেশতার সিফাতে রূপান্তরিত হয়।
রোযা রেখে মিখ্যা বলা, পরনিন্দা করা, গীবত করা মহাপাপ। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোযা রেখে অবাঞ্ছিত কথা ও কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে না, তার পানাহার ছেড়ে উপাস করাতে আল্লাহ্র কোনো দরকার নেই।’ রোযাদার মাপে কম দিতে পারে না, দুর্নীতি করতে পারে না, মদ্যপান করতে পারে না, অসৎ চিন্তা করতে পারে না। হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুলাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৭৭০; সুনানু আবী দাউদ, হাদীছ নং ২০১৫; জামি‘উত্-তিরমিযী, হাদীছ নং ৬৪১; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, হাদীছ নং ১৬৭৯; মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নং ৯৪৬৩)।
রোযার দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর আক্লের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় এবং রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। কেননা ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা হ্রাস পায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় এবং অন্তর বিগলিত হয় মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের প্রতি কৃতজ্ঞতায়।
রোযার দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহ্র ভয়-ভীতি এবং আত্মশুদ্ধির গুণ সৃষ্টি হয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘যাতে তোমারা আত্মশুদ্ধির গুণ অর্জন করতে সক্ষম হও।’
রোযার মাধ্যমে মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয় এবং মানব মনে আল্লাহ্র আযমত ও মহানত্বের ধারণা জাগ্রত হয়। মানুষের দূরদর্শিতা আরও প্রখর হয়। মানব মনে এমন এক নূরানী শক্তি সৃষ্টি হয়, যার দ্বারা মানুষের সৃষ্টির এবং বস্তুর গুঢ় রহস্য সম্বন্ধে অবগত হতে সক্ষম হয়। রোযার বরকতে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ এবং পরস্পরের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হয়।
ইবনুল-কায়্যিম বলেন, ‘রোযার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদা সমূহের মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা। সিয়াম সাধানার মাধ্যমেই মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। চিরন্তন জীবনের অনন্ত সাধনার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে।’
মাহে রমযানের এ মহিমান্বিত মাসে আমাদের সমাজের পথহারা ও বিভ্রান্ত মানুষ সঠিক পথের দিশা লাভ করুক। চরিত্র, মাধুর্য ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করুক। এটাই রাব্বুল আলামীনের কাছে আমাদের একান্ত কামনা ও বাসনা।
মাহে রমযান নৈতিকতা শিক্ষা দেয়
রোযা মানুষকে সকল প্রকার অপরাধ ও অনৈতিক কার্যাবলী থেকে বিরত রাখে। রমযান মাস মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। এ মাসই নৈতিক শিক্ষার উপযুক্ত সময়। আত্মার উন্মেষের মাধ্যমেই নৈতিক চরিত্র গঠিত হয়। চরিত্র মানুষকে মহিয়ান ও গরিয়ান করে তোলে। সবর, শোকর, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি মানুষের সৎগুণ। এগুলো সৎ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যাবলী। রোযা মানুষের মধ্যে এ সকল উত্তম গুণে গুণান্বিত করে।
মুসলমানদের ধর্মীয় ও জাতীয় জীবনে মাহে রমযান অতি মুবারক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। ইসলামের শিক্ষাসমূহের মধ্যে অন্যতম বুনিয়াদী শিক্ষা হলো মানুষের নৈতিক চরিত্র সংশোধন ও শিক্ষাদান। মানুষের নৈতিক চরিত্র, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সংশোধন ও পরিমার্জন এমন এক মহান কাজ যার পূর্ণতা বিধানের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে নবী হিসেবে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল।
এই মুবারকপূর্ণ মাস একদিকে অন্ধকার যুগের তিরোধান এবং অন্যায়, অত্যাচার ও অধর্মের অবসান ঘোষণা করে; অন্যদিকে একটি নতুন যুগ, ন্যায়, সত্য ও আলোর যুগে আবির্ভাবের মহা পয়গাম জানায় বিশ্ববাসীকে। এ মাসেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়। এটি মানব জাতির পথ প্রদর্শকরূপে এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট প্রমাণ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী স্বরূপ।
সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের আচরণ দেখে বন্য পশুরাও ঘৃণাবোধ করে। অন্যায়, অশীলতা, পাশবিকতা তাদের জীবন সংগী। রোযা মানুষ থেকে এ সংক্রামক ব্যাধি দূর করে তাকে পুতঃ-পবিত্র ও নিষ্কলুষ করে। হযরত মু‘আয ইব্ন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ বলেন, আস্-সাওমু জুন্নাতুন অর্থাৎ ‘রোযা ঢাল স্বরূপ’ (সুনানুন্-নাসাঈ, হাদীছ নং ২১৯৬, ২১৯৫)। ঢাল যেমন শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। রোযাও মানুষকে সকল প্রকার অন্যায় থেকে রক্ষা করে।
মানুষের একটি অন্যায় অভ্যাস হচ্ছে মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এবং মিথ্যার ওপর চলা। রোযা মিথ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে। রোযা মানুষকে আল্লাহর সম্মুখে হাযির করে দেয়। সে আল্লাহকে ভয় করে তাঁর হুকুমের প্রতি শ্রদ্ধা করেই দীর্ঘ সময় ধরে মিথ্যাকথা, পরনিন্দা চর্চা, অন্যায় অপবাদ, কুমন্ত্রণা, পানাহার, পাপাচারসহ সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত থাকে।
মিথ্যা সকল অন্যায়ের মূল। রোযাদার রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলতে পারে না, কাউকে ফাঁকি দিতে পারে না, কালোবাজারি করতে পারে না, মুনাফাখুরী করতে পারে না, অন্যের হক গ্রাস করতে পারে না, কারও প্রতি যুলুম-নির্যাতন করতে পারে না।
রোযা সমাজ জীবন থেকে অশ্লীলতা পরিহারে সাহায্য করে। নিয়ন্ত্রণ করে সকল অন্যায় গর্হিত কাজ থেকে। রমযান ঝগড়া-ফাসাদ ও বিপর্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘যদি কেউ রোযাদারের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় বা মারামারি করে তখন সে যেন বলে, আমি রোযাদার।’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৭৭১, সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৯৪৪; মুসনাদু আহমাদ, হাদীছ নং ২৪৮৭৫)। অর্থাৎ রোযামুখে গাল-মন্দ করা বা সংঘাতে লিপ্ত হওয়া যায় না। সুদীর্ঘ একমাস ব্যাপী এ অভ্যাস গড়ে উঠলে অবশিষ্ট মাসগুলোতেও মানুষ এসব অনাহুত কর্মকা- থেকে বিরত থাকবে। আর এতে নেমে আসবে সমাজে শান্তির পরিবেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন