শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই

প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো শহরে সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে গত শনিবার রাতে এক বন্দুকধারীর গুলিতে ৫০ জন নিহত ও ৫৩ জন আহত হয়েছেন। এই মর্মন্তুদ প্রাণহানিকর ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বন্দুকধারীর হামলায় এত মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেনি। অরল্যান্ডোর মেয়র বডি ডিয়ার বলেছেন, এটি কোনো জনসমাগমস্থলে গুলি চালিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যার ঘটনা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য বন্দুকধারীর হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ঘটনার আগের দিন এই অরল্যান্ডো শহরেই এক কনসার্টে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন পপ সঙ্গীতশিল্পী ক্রিস্টিনা গ্রিমি। খবরে জানা গেছে, নাইট ক্লাবে হামলাকারী ওমর মতিন আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। পুলিশ তাকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করেছে। তার সম্পর্কে খবরে বলা হয়েছে, এর আগে তার নাম সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর তালিকায় ছিল না। তবে অন্য একটি অপরাধমূলক ঘটনার জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছিল, যার সঙ্গে নাইট ক্লাবে হামলার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফক্স নিউজ অবশ্য জানিয়েছে, তিনি এফবিআইর সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন। এনবিসির মতে, ওমর মতিন হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের জরুরি নম্বর ৯১১-তে ফোন করে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। আইএস এর মধ্যেই এই হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। বলেছে, ওই সশস্ত্র হামলা, যাতে শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে, তা একজন আইএস যোদ্ধা চালিয়েছে। কেন এবং কী কারণে এই নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়, হামলার পেছনে আসলেই কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর প্ররোচনা, মদদ বা সংযোগ ছিল কি না, তা সুনিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হতো যদি ওমর মতিন জীবিত থাকতেন বা তাকে জীবিত গ্রেফতার সম্ভব হতো। তার অবর্তমানে হয়তো প্রকৃত সত্য কখনোই জানা যাবে না। কিংবা যা জানা যাবে তা হয়তো পুরো সত্য হবে না।
যা হোক, এই হামলা ও হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, এটি একটি বিদ্বেষপ্রসূত ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একজন মুসলমান নামধারী ব্যক্তির দ্বারা এই হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের তাবৎ মুসলমান সংকুচিত, বিব্রত, লজ্জিত এবং একই সঙ্গে উৎকণ্ঠিত। কারণ, এই ঘটনাকে উপলক্ষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হেইট ক্যাম্পেইন জোরদার হতে পারে, অমুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে, এমনকি তারা হামলার শিকারও হতে পারে। এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আবশ্যক যে, ইসলাম এ ধরনের হামলা ও হত্যাকা- কখনোই সমর্থন করে না। পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে : ‘নরহত্যা অথবা দুনিয়ার ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকেও হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল’ (সূরা মায়েদা, আয়াত-৩২)। এই যেখানে ধর্মের নির্দেশ, সেখানে তার অনুসারীরা সন্ত্রাস ও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত হতে পারে না। যারা সন্ত্রাসী ও হত্যাকা- ঘটায় তারা প্রকৃত মুসলমান বলে পরিগণিত হতে পারে না। তাই বিভ্রান্ত, বিশৃঙ্খল ও বিপথচারী কোনো মুসলমান নামধারীর অপরাধ অপকর্মের দায় মুসলমানরা নিতে পারে না। সে দায় তাদের ওপর চাপানোও সঙ্গত নয়। ওমর মতিন যে অপরাধ করেছেন তার দায় তারই। মুসলমানরা এ দায় নেবে না। তাদের ওপর দায় চাপানোও উচিত হবে না। তার পিতা জানিয়েছেন, সমকামীদের প্রতি ঘৃণা থেকে তার ছেলে এ কাজ করে থাকতে পারে। এখানে বলা দরকার, ইসলামে সমকামিতা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইসলাম তাকে মোটেই সমর্থন করে না। সমকামী বা সমকামীদের প্রতি মুসলমানদের ঘৃণা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, মূল্যবোধ, নীতিবোধ ও আইন সমকামিতা স্বীকার করে। সে ক্ষেত্রে মুসলমানদের উচিত যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক মূল্যবোধ ও আইন মান্য করে চলা। ওমর মতিনের পিতা যা বলেছেন তা সত্য হলেও তাতে তার অপরাধ বিন্দুমাত্র লঘু হয় না। ওমর মতিন যে খুব ধর্মগতপ্রাণ ছিলেন এমন সাক্ষ্য কেউ দেয়নি। তার সাবেক স্ত্রী তাকে একজন বিশৃঙ্খল এবং খানিকটা অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। ওমর মতিনের পিতা বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমরাও এটাই বলতে চাই, এ ঘটনার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক টেনে আনা ঠিক হবে না। এ জন্য ঢালাওভাবে মুসলমানদের দায়ী করা, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো ও বিষোদগার করাও ঠিক হবে। যে কেউ লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, বিশ্বের যেখানেই মুসলিম ও ইসলামের নামে কিংবা ইসলামী সংগঠনের নামে জঙ্গি হামলা ও হত্যাকা- হোক না কেন, তার প্রধান প্রতিবাদকারী হয়ে দাঁড়ায় মুসলমানরাই। অরল্যান্ডো শহরে সংঘটিত হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনারও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা। এটাও লক্ষ্য করা গেছে, প্রতিটি জঙ্গি হামলার পর বিশ্বের মুসলমানরা নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছে। তাদের নানা রকম হয়রানি, জুলুম ও ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। আলোচ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে তেমন কিছু যেন না হয় সেটাই আমরা কামনা করি। বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবধর্মের মানুষের মধ্যে সদ্ভাব, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যখন জরুরি, তখন কোনো ধর্ম বা ধর্মানুসারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বিভ্রান্তি যাতে না ছড়ায় সেটা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। অরল্যান্ডের হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় মার্কিন জনগণের মতো আমরাও দুঃখিত, মর্মাহত ও শোকাভিভূত। আমরা হতাহতদের পরিবার-পরিজন, মার্কিন জনগণ ও সরকারের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির বিকাশ ঘটুক, এই প্রার্থনা করছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন