আমরা লংকাকান্ডের কথা শুনেছি। সেখানে রাবণ নামে এক রাক্ষস বধের কাহিনী বর্ণনা করা আছে। আমাদের দেশেও ইদানীং নানা কান্ডের কথা শোনা যাচ্ছে। এই যেমন রূপপুরের বালিশকান্ড বা হালের পর্দাকান্ড। তারপর আবার প্রকাশিত হলো ধান বীজ বাবদ তিন কোটি টাকা দুর্নীতির খবর। প্রতিনিয়তই এমন খবর থলে ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। অবশ্য থলের বিড়াল তো একদিন না একদিন বের হয়ে আসবেই। আমাদের দেশের রথী মহারথীদের দুর্নীতির এটি ক্ষুদ্র একটি অংশ। বড় বড় পদে থেকে অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে গরিবের হক চুরি করে নিজেদের ভুড়ির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বৃদ্ধির চেষ্টায় মনোনিবেশ করেন। দায়িত্ব গোল্লায় যাক! আরও কত কান্ড অপ্রকাশিত রয়েছে তার হিসাব নেই। যারা এইভাবে দুর্নীতি করে দেশের বারোটা বাজাচ্ছে তাদের চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা কোথায় যাচ্ছে? এসব দুর্নীতিবাজ মানুষের মতোই দেখতে! অথচ কর্মকান্ড মানুষের মতো না! দুর্নীতিবাজদের অপরাধ খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। দেশটা যখন উন্নতির দিকে ধাবমান তখন এসব দুর্নীতিবাজ মানুষের জন্য উন্নয়নের সুফল দেশের প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। ফলে উন্নয়নের সুফল তারা কমই ভোগ করতে পারছে। তাদের প্রাপ্য সুবিধা নিয়ে ওপর মহলের কতিপয় দুর্নীতিপ্রবণ মানুষ আরাম-আয়েশে বিলাসবহুলভাবে জীবন কাটাচ্ছে। দুর্নীতির ঘূণপোকা দেশের উন্নয়নকে কেটে শেষ করে ফেলছে। পকেট মোটা করতে পারাতেই দুর্নীতিবাজদের আনন্দ। সে যে কোনো উপায়েই হোক না কেন। সবাই কাজের বিনিময়ে উপরি পাওনার খোঁজ করে। এভাবে অধিকাংশই যদি দুর্নীতিপ্রবণ আচরণ করে তবে সাধারণ মানুষের কী হবে? দুর্নীতি মানুষ কেন করে, এমন প্রশ্নের সোজা কোনো উত্তর নেই। কারণ বেতন আগের চেয়ে বেশি হলেও তেমন কোনো উপকার হয়নি। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা কমেনি। সরকারের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ টাকা যেকোনভাবে নিজের পকেটে ঢোকাতে ব্যস্ত সবাই।
মানুষ কেবল টাকার জন্যই দুর্নীতি করে না। এটা কারও কারও স্বভাব! তার মানে, পেটের ক্ষুধা মিটলেও মনের ক্ষুধা থেকেই যায়! তাই মোটা বেতন পাওয়ার পরেও অনেকে টেবিলের নিচ দিয়ে নেয়া পাওনাটাকে ছাড়তে পারে না। এই দেয়া-নেয়া দুটোই আজ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। দিতেও যেমন বিবেকের কাছে উত্তর দিতে হয় না, নিতেও বিবেকের কাছে উত্তর দিতে হয় না। সমাজের কাছেও তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একজন সাধারণ চাকুরিজীবীর কীভাবে আলিশান বাড়ি হয়, দামী গাড়ি হয়, রাজকীয় জীবন হয় তার কোনো জবাব নেই। তার দুর্নীতির ব্যপারে কানাঘুষা হলেও না দেখার ভান করেই থাকি আমরা। উপরন্তু তাকেই সমাজের হর্তাকর্তা মনে করি। কারণ তার তখন অনেক টাকা। দেখে দেখে আর প্রশ্নও করতে ইচ্ছে হয় না। কাজের প্রতি সততা, নিষ্ঠা বা একাগ্রতা এগুলো আজ অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। নিজের আখের গোছানোতেই ব্যস্ত সবাই। উপরি পাওনা নিতে নিতে অভ্যাসটা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে এটা যেন আয়ের বৈধ কোন পথ! প্রতিটি সেক্টরে উপরি পাওনার সিস্টেম আছে। যে নিতে জানে সে যেকোন পরিস্থিতিতেই ঘুষ নেয়। কোন কোন সেক্টরের উপরি পাওনা নেয়ার সুযোগ একটু বেশি। সেসব সেক্টরে চাকরির জন্য চাপ থাকে বেশি। এই চাকরি পাওয়াটাও আমাদের দেশে বিশাল একটা ব্যাপার। মানে, এখানেও সেই দুর্নীতির বিষয়। চাকরিটাই যেখানে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে নেয়া হয়, সেখানে কতটুকু ভালো আশা করা যুক্তিসঙ্গত? যার উপরি পাওনার সামর্থ্য আছে সে উপরি দিয়ে নিজের পাওনা আদায় করে নেয়। টাকার জোরে কত যোগ্যতমকে টপকিয়ে তার থেকে কম যোগ্যতার মানুষ চাকরি পাচ্ছে তার হিসাব কে রাখছে। যার সামর্থ্য নেই সে বেকার থাকছে। এ যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপরি পাওনা নিয়ে ছোট্ট একটা গল্প চালু আছে। কোন এক সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী তার প্রতিবেশী শিক্ষকের স্ত্রীকে নতুন শাড়ি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভাবী, আপনি মাসে কয়টি নতুন শাড়ি কেনেন? জবাবে শিক্ষকের স্ত্রী না জবাব দিলে সেই কর্মকর্তার স্ত্রী বলেন, তার স্বামী প্রায় প্রতিদিনই নতুন শাড়ি উপহার দেয়। দুর্নীতির মধ্য দিয়ে অনেক তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও বাড়ি-গাড়ির মালিক। মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয়। দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলে সব রাগ গিয়ে পরে গণমাধ্যমের ওপর। সে দুর্নীতি করছে তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু তা প্রকাশ হলে একটু আধটু রাগ তো হতেই পারে! পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষ একটু শান্তি পায়। অন্তত একজন দুজন হলেও তারা ধরা তো পড়ছে। এভাবেই একদিন দুর্নীতির শেকড় উপড়ে যাবে। তাই গণমাধ্যমে আমরা এসব পড়ে একটু শান্তি পাই। যারা ধরা পড়ছে তারা শাস্তি পাচ্ছে কিন্তু যারা এখনও বহাল তবিয়তে থেকে পকেট ভারী করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের খোঁজ নিতে হবে। এসব ঘূণপোকাকে চিহ্নিত করা না গেলে দেশের উন্নয়ন এরা শেষ করে দেবে। কোটি টাকা, বাড়ি, গাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন থাকতে পারে। তবে সেই স্বপ্নটা অবৈধ উপায়ে পূরণ করার ইচ্ছাটাই সব নষ্টের মূলে। বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বারবার কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। ঘুষ দেয়া ও নেয়া বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওই যে একটা প্রবাদ আছে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। অবস্থাটা অনেকটা সেরকমই। দুর্নীতির শিকার হয় প্রান্তিক মানুষগুলো। এই মানুষগুলোর ঘামে ভেজা টাকায় উন্নয়নের ধারা প্রবাহিত হয়। আর দুর্নীতিবাজদের কারণে সেই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এরকম দুএকটি ঘটনা নয়, ধীরে ধীরে সব পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দুর্নীতির কারণে কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয় আবার কেউ শুকিয়ে মরে। সমাজে বিভাজন তৈরি হয়। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ তৈরি হয়। রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে সমাজের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠে অনেকে। দুর্নীতিবাজদের ধরতে দুদকের অভিযান আরও জোরদার হতে হবে। কোনোভাবেই দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেয়া চলবে না।
নতুন পে স্কেলের আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এটা করেছেন। এটার একটা উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি কাজে যাতে দুর্নীতি না হয়। প্রয়োজন যদি মিটে যায় তাহলে কেন অসততার আশ্রয় নেয়া? আবার যদি সেই অর্থনীতির কথায় বলি তাহলে প্রয়োজনের কি আর শেষ আছে! তাই যত বেতনই বাড়ানো হোক না কেন ‘উপরি পাওনা’ ছাড়ে কী করে? ঢেঁকি যে স্বর্গে গেলেও ধানই ভাঙে! যত সুখেই থাক আরও চাই। রাজার ভান্ডার উজাড় করে দিলেও তারা দুর্নীতি বন্ধ করবে না। দেশের যা হয় হোক নিজের পকেট তো ভর্তি হোক। দেশের ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা না থাকলে বিদেশে যাও। সেখানে বাড়ি-গাড়ি তৈরি কর। আমরা নিজেরা নিজেদের লোভের জায়গা থেকে সরে না আসলে দুর্নীতি কোনোকালেই একেবারে শেষ হবে বলে মনে হয় না।
যে কোন দেশের জন্য উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে সেদেশের চলমান দুর্নীতি কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি উন্নয়নের এই ক্রমবর্ধমান ধারাকে পেছন থেকে টেনে ধরছে। ফলে কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য অর্জনের রাস্তা বিলম্বিত হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা যে ছোটখাটো প্রতারণামূলক আচরণ করি সেটাও দুর্নীতি। কিন্তু যেহেতু এগুলো আমাদের চারপাশে নিত্য ঘটে চলেছে, আমরা তাই সেগুলোকে দুর্নীতির ভেতরেই ফেলতে চাই না। দুর্নীতি দমন কমিশন যখন দুর্নীতির জন্য কাউকে আটক করে তখন আমরা তার দিকে আঙুল তুলি। তাকে একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ হিসেবে জানি। এটা মনে রাখা জরুরি যে, বড় কোন অপরাধের জন্মও ছোট অপরাধ থেকেই হয়। কোন পরিবারের সন্তান যদি মিথ্যা বলে, প্রতারণামূলক কাজ করে, চুরি করে তবে সেগুলোও পরবর্তীতে অভ্যাসে পরিণত হতে পারে। আবার ঘুষ নেওয়া কোন কর্মকর্তার পরিবারের কোন সন্তান বড় কোন চাকুরি পেলেও তার ঘুষ নেওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সে এই শিক্ষা তার পরিবারের কাছ থেকেই পেয়েছে। এভাবেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে পরিবার থেকে সমাজে,সমাজ থেকে রাষ্ট্রে। দুর্নীতি সমাজটাকে ঘিরে ফেলেছে। প্রতি ক্ষেত্রেই এই উপরি ইনকামের প্রশ্ন। সে সেবা হোক বা বাণিজ্য হোক। যদি সেবা হয় তো সেখানে দালাল বাহিনী প্রস্তুত। আপনার কাজ যত কঠিনই হোক না কেন এই দালালদের কাছে তা হাতের ময়লা। শুধু আপনি পকেট থেকে কিছু বের করলেই হলো! দুর্নীতিবাজরা এভাবে অবৈধ আয় করে দেশটাকে পিছিয়ে দিচ্ছে, তা একবারও ভেবে দেখছে না। একবারও দেশটাকে সোনার বাংলা গড়ে তোলার কথা চিন্তা করছে না। তারা আছে ব্যাংক ব্যালান্স মোটা করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে। একে একে কত কান্ড প্রকাশিত হচ্ছে! সামনে আবার কোন কান্ড প্রকাশিত হয় আমরা তা দেখার জন্যই অপেক্ষা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন