বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরুর আগে নতুন বিতর্কও শুরু হয়েছে। গত বুধবার বরগুনার বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মামলার চার্জশিট গ্রহন করে পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারীর আদেশ প্রদান করেছেন। আগামী ৩ অক্টোবর মামলাটির চার্জসীটের গ্রহনযোগ্যতার ওপর শুনানীন দিন ধার্য রয়েছে। চার্জশিটের সাথে পুলিশ একটি ভিডিও ক্লিপও জমা দিয়েছে। তবে ঐ ঘটনায় আরো দুটি ভিডিও ভাইরাল হলেও তা আমলে নেয়নি পুলিশ। মিন্নির আইনজীবীদের দাবী ঐ দুটি ভিডিও ক্লিপ আদালতে উপস্থাপন করলে পুলিশের দাবী মতে এ হত্যাকান্ডে যে মিন্নি জড়িত নয় তা প্রমানে সহায়ক হতে পারে বিধায় তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি এ হত্যা মামলার বাদী নিহত রিফাতের পিতা মিন্নিকে প্রধান স্বাক্ষী করে এজাহার করলেও পরবর্তিতে তাকেই অভিযূক্ত করে সংবাদ সম্মেলন সহ মানববন্ধনে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তাকে অনেকেই ‘মনগড়া’ বলে দাবী করে বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
অপরদিকে তৃতীয় ভিডিওটি ভাইরাল হলে পুলিশ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এরপরে ১৬৪ ধারায় মিন্নির দেয়া জবানবন্দী প্রকাশ করেছে একটি মহল। যাতে মিন্নি ও নিহত রিফাতের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এমনকি ‘মিন্নি কার স্ত্রী’ পরোক্ষ ভাবে সে প্রশ্নও উঠে আসছে। তবে বাবা তার মেয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বার বারই বলেছেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ লাইনে ডেকে নিয়ে টানা ১২ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয় মিন্নিকে। সেখানেও ৪৮ঘন্টা পুলিশ হেফাজাতে থেকে পুলিশের শেখানো জবানবন্দী দিতে বাধ্য হয়েছে মিন্নি’।
বরগুনা ও বরিশালের একাধিক সিনিয়র আইনজীবীর মতে, মূল অভিযূক্তদের বিচারের চেয়ে একটি মহল মিন্নিকে ফাঁসাতে গিয়ে মামলাটির ভীতই দূর্বল করে ফেলেছেন। এমনকি ঐ হত্যাকান্ডের প্রধান অভিযূক্ত নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হবার কারনেও এ মামলার অনেক কিছু আড়াল হয়ে গেছে বলে মনে করেন ঐসব আইনজীবীগন।
রিফাত হত্যাকান্ডে তদন্ত শেষে পুলিশ দুটি চার্জশিট জমা দিয়েছে। এর মধ্যে এজাহারে প্রধান স্বাক্ষী নিহতের স্ত্রী মিন্নি সহ ১৪ জনের নামে একটি চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। অপর ১০ অপ্রাপ্ত বয়স্কর বিরুদ্ধে একটি ভিন্ন চার্জশিট জমা দেয়া হয়েছে। যাদের বিচার হবে শিশু আইনে। এসব শিশু-কিশোর বর্তমানে যশোরে কিশোর সংশোধনাগারে রয়েছে।
এদিকে উচ্চ আদালতে মিন্নি জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হবার আগেই ১ লা সেপ্টেম্বর পুলিশ এ হত্যা মামলায় চার্জশিট দাখিল করলেও তার পরেই একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যাতে দেখা গেছে ২৬ জুন সকাল ১০টা ২১ মিনিটে রক্তাক্ত অবস্থায় রিফাতকে স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি বুকে আগলে একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সায় করে বরগুনা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে নিয়ে আসে। এসময় এক যুবক রিক্সাটির দিকে ছুটে এসে আবার জরুরী বিভাগে ছুটে গিয়ে একটি স্ট্রেচার নিয়ে আসে। ইতোমধ্যে আরো কয়েকজন সেখানে জড়ো হয়। অচেতন রিফাতকে স্টেচারে শুইয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসপাতালের সামনে রক্তমাখা হাতে মিন্নি উপস্থিত একজনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন চেয়ে নিয়ে কারো সাথে কথা বলে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে হাসপাতালের সামনে একটি এ্যাম্বুলেন্স আসে। ইতোমধ্যে রিফাতের বন্ধু ‘জন’ সহ আরো কয়েকজন হাসপাতালের সামনে আসে। সকাল ১০.৪৪ মিনিটে রিফাতকে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। ১০.৪৯মিনিটে এ্যাম্বুলেন্সটি বরগুনা সদর হাসপাতাল চত্তর ত্যাগ করে। বরগুনা হাসপাতালের সামনে পুলিশ এবং হাসপাতাল কতৃপক্ষের দুটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এর যেকোন একটির ঐ ভিডিওটি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
রিফাতে বাবা তার দায়ের করা এজাহারে মিন্নিকে এক নম্বর স্বাক্ষী করলেও কয়েকদিনের মধ্যে মত পরিবর্তন করেন। ১৩ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তিনি অভিযোগ করেন ‘রিফাতকে নয়ন বন্ড গ্রুপ ধরে নেয়ার সময় মিন্নি নির্লিপ্ত ছিল। এমনকি কুপিয়ে জখম করার পরে মিন্নি রিফাতকে হাসপাতালে নেয়ার পরিবর্তে নিজের জুতা খুজছিল এবং হামলাকারীদের একজন তাকে হাতব্যাগ তুলে দিচ্ছিল বলে অভিযোগ করে তার ছেলে একাই রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে যায় বলেও জানান। এমনকি রিফাতকে এ্যাম্বুলেন্সে করে বরিশালে নেয়ার সময়ও স্ত্রী মিন্নি তার সাথে যায়নি বলে অভিযোগ করেন ।
তবে নুতন ভিডিওটি ভাইরাল হবার পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রিফাতের পিতা আবদুল হালিম জানন, ‘সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর জখম হবার পরে রিফাত একাই রিক্সায় করে হাসপাতালে যাচ্ছিল, কিছুদুর যাবার পরে মিন্নি সে রিক্সায় ওঠে’।
এদিকে পুরো বিষয়টি নিয়ে একাধিক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া রিক্সা চালক দুলাল জানান, ‘ঐদিন বরগুনা শহরের কলেজ রোডে যাত্রী নিয়ে গেলেও মারামারির কারনে লোকের ভীড়ে আর সামনে আগাইতে পারিনি। যাত্রী নামিয়ে রিকসা ঘুরাবার সাথেই রক্তাক্ত একটি ছেলে আমার রিকাসায় কোন মতে উঠে বলে ‘চাচা আমাকে হাসপাতালে নিয়া যান’। এটাই ছিল ছেলেটির শেষ কথা। আহতের গলা ও বুকের বাম পাশে ক্ষত থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। রিক্সা চালক দুলাল রিফাতের গায়ের ছেড়া জামা টেনে সেসব স্থানে চেপে ধরে তাকে বলে, ‘আপনি একটু চাইপ্পা ধরেন’। এসময় একটি মেয়ে দৌড়ে এসে রিকসায় উঠে ছেলেটিকে ধরে বসে। এরপরে দ্রুত সে রিক্সা নিয়ে হাসপাতালে যায়।
দুলালের মতে রক্তাক্ত ছেলেটি মিনিটখানেক মাথা সোজা রাখতে পেরেছিল। এরপরেই তার মাথা ঢলে পড়ে মেয়েটির কাঁধে। এসময় একটি মোটার সাইকেল রিকসার পাশ দিয়ে যাবার সময় মেয়েটি তাদের কাছে রক্তমাখা স্থান চেপে ধরতে কাপড় চাইছিল, তারা কোন সদুত্তর দেয়নি। মেয়েটি রিক্সা চালক দুলালের কাছে মোবাইল চাইলে তার কাছে কোন ফোন নেই বলে জানায়। ঐ মোটর বাইকের আরোহীদের কাছেও সে ফোন চাইলে তারা কোন ফোন নেই বলে জানায়।
এ অবস্থায় সে রিফাতকে নিয়ে হাসপাতালে পৌছার পরে সেখানে একটি লোক দৌড়ে আসে। রিক্সা চালক দুলাল তাকে নিয়ে হাসপাতালের ভেতর থেকে স্ট্রেচার নিয়ে এসে, ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুলালের বর্ণনামতে ঐ লোকটি স্থানীয় এ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী মামুন। মামুন সাংবাদিকেদের সাথে আলাপকালে হাসপাতালের একই বর্ণনা দিয়েছেন। দ্রুত রিফাতকে জরুরী বিভাগ থেকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পরে তিন দফায় তার জন্য ওষুধও এনে দেন মামুন। ডাক্তার গজ বেন্ডিজ দিয়ে ক্ষতস্থান আটকে তাকে দ্রুত বরিশালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। রিফাতকে এ্যম্বুলেন্সেও তোলা হয়। ইতোমধ্যে মিন্নির বাবা ও চাচা হাসপাতালে পৌছে বলে জানিয়ে মামুন জানান, মিন্নি রিফাতের সাথে যাবার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও সবাই তাকে বাড়ীতে থেকে যাবার কথা বলে রেখে যান। এদিকে রিফাতকে হাসপাতালে পৌছে দেয়ার পরে সেখানে পুলিশ পৌছে। পুলিশ রিক্সা চালক দুলাল ও তার রিক্সার ছবি তুলে নেয়। এমনকি তার রিক্সার কাগজপত্রও পুলিশ নিয়ে গেছে। যা এখনো সে ফেরত পায়নি বলে জানিয়েছে। তবে রিফাত হত্যা মামলায় রিক্সা চালক দুলাল ও এ্যাম্বুলেন্স ব্যাবসায়ী মামুনকে সাক্ষী করা হয়েছে কিনা তা এখনো জানা যায়নি।
নতুন ভিডিওটি ভাইরাল হবার পরে বরগুনা সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে রিফাত হত্যাকান্ডের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ হত্যাকান্ডের পরেই বরগুনা শহরে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের গডফাদার হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেতার পুত্রের নামটি সবার মুখে উচ্চারিত হয়। প্রধান আসামী নয়ন বন্ড নিহত হবার পরে বিষয়টি নিয়ে মানুষের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। আর স্ত্রী মিন্নিকে আসামী করার পরে সে ব্যাপারে সাধারন মানুষের আরো স্বচ্ছ ধারনা জন্মে।
এ ব্যাপারে হাইকোর্টে মিন্নির আইনজীবী এবং আইন ও সালিস কেন্দ্রের জেড আই খান পান্না সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ ভিডিওটি মামলায় নতুন মোড় নেবে। সিনিয়র এ আইনজীবীর মতে মূলত সন্দেহের বসেই মিন্নিকে আসামী করা হয়েছে। তার মতে এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্যও ছিল, আর তা হচ্ছে মূল আসামীদের রক্ষা করা। জেডআই খান পান্নার মতে রিফাতের বাবা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এতদিন এ হত্যকান্ডের সাথে মিন্নিকে জড়িয়েছিলেন। নতুন ভিডিওটি তার সে দাবী অনেকটাই অসাড় প্রমানিত করবে বলেও দাবী করেছেন তিনি। তার মতে, পুলিশ শুধু দ্বিতীয় ভিডিওটি নিয়ে চার্জসিট তৈরী করেছে। আমরা ৩টি ভিডিও নিয়েই এখন আগাব।
এদিকে আলোচিত এ রিফাত হত্যা মামলার বিষয়ে বরিশাল ও বরগুনার একাধীক আইনজীবী জানিয়েছেন, এ মামলার বিচার শুধু বরগুনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা উচ্চ আদালতেও গড়াতে পারে। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে এখনই কারো স্বস্তি লাভের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহ বরিশাল বিভাগের পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন জানিয়েছেন, ‘তথ্য প্রমানে যা পাওয়া গেছে সে আলোকেই চার্জশীট হয়েছে। এর বাইরে কিছু বলার নেই’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন