মিয়ানমার তৈরি করছে ইয়াবা আর ভারত তৈরি করছে ফেনসিডিল। ইয়াবা আর ফেনসিডিল সেবন করছে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। ফলে ভারত আর মিয়ানমার এ দেশের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পত্রিকার সূত্র মতে, দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক দ্রব্য বেচাকেনা করা করা হয়। পত্রিকা মারফতে জানা যায়, প্রতিদিন রাজধানী ঢাকা শহরেই ইয়াবা বাবদ হাত বদল হয় ৭ কোটি টাকা। মাদক গ্রহনকারীর সংখ্যা কারো জানা নেই। তবে সরকার বলছে মাদকাসক্তদের সংখ্যা ৫০ লাখ। আর বেসরকারি হিসাব মতে, ৭০ লাখের ও বেশি। এদের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতী। মাদক গ্রহণকারী ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। ঢাকা শহরে শুধু ১০ লাখ মাদক সেবী রয়েছে। তার মানে ৬৮ হাজার গ্রামে গড়ে ১০৭ জন করে মাদকসেবী রয়েছে।
২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীদের সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মিয়ানমার থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ বাংলাদেশ কে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেনসিডিল কারখানা। সংঘবদ্ধ দল মিয়ানমার হতে কক্সবাজার দিয়ে সারা দেশে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা। নতুন নেশার ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে যুব সমাজ। মাদকের করাল গ্রাস থেকে সন্তানদের না ফিরাতে পেরে পরিবারের শান্তি রক্ষায়, বাবা মা তার সন্তানকে পুলিশি সোর্পদ করছেন। মাদকাসক্ত সন্তানদের হাতে পিতা-মাতাও জীবন হারাচ্ছে অহরহ।
আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে ছিল। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সর্ম্পকিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরা পথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হিফাজাতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতিসাধনকারী এই মাদক সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কল্পে ১৯৯০ সালের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রনয়ণ করা হয়। ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি থেকে এই আইন কার্যকর হয়। কুড়ি বছরেরও অধিককাল পথ পরিক্রমায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ হয়নি। এর প্রসার বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি নিয়ে। আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়নি বলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার টেকনাফে ২ লাখ মানুষের মধ্যে ৮০ হাজার ব্যক্তি কোন না কোনভাবে ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী পুরুষ উভয় শ্রেণির মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। ডিশ এন্টিনার যুগে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন এ দেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে নেশাগ্রস্ত করার মানষিকতা তৈরি করছে। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাস গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। মাদক দ্রব্য বর্তমান বিশ্বে ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা।
বাংলাদেশে ইয়াবার মূল উৎস মিয়ানমার। সেখানে বিক্রি হয় কেজি কিংবা টনে। বাংলাদেশে আসার পর তা বিক্রি হয় কাট হিসেবে। প্রতিকাটে থাকে ১০,০০০ পিস ইয়াবা। নানাভাবে চোরাচালান হয়। কলার মধ্যে আনা হয়। অপারেশন করে পেটের মধ্যে পর্যন্ত ঢুকিয়ে আনা হয়। ট্রাকের টায়ার কেটে আনা-নেওয়া করা হয়। এছাড়া গাড়ির হেড লাইটের ভেতরে ও চেয়ারের স্টিলের পাইপের ভিতরে এসব অবৈধ দ্রব্য আনা হয়। আবার মহিলাদের দ্বারা এই অপরাধ কার্য সংগঠিত করা হচ্ছে।
মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতি সংঘের একটি জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ আর ১৩ ভাগ নারী। এক লাখের মত নারী মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী কিশোররা এই ব্যবসার সাথে জড়িত। আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে কোন সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকার মুদ্রা পাচার হচ্ছে। কিন্তু ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্য দেশে আসে। এর মধ্যে ফেন্সিডিলই আসে ২২০ কোটি টাকার। শতকরা ৬০ ভাগ মাদকাসক্ত মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। মূলত: ভারত থেকে আসছে মাদকের বড় বড় চালান। জানা যায়, বিস্তীর্ণ সীমান্তের ৫১২টি পয়েন্টেকে মাদক আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করে চোরাচালানীরা। এসব পয়েন্টে বিশেষ নজরদারী না থাকার কারণে রাত দিন আসছে হেরোইন, আফিম, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মাদক সংক্রান্ত মামলা ঝুলে আছে। র্যাব ও পুলিশের হাতে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে তদন্তনাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। মামলা হলে স্বাক্ষী প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। রাজধানীতে মাদক ব্যবসার ‘বাজার’ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এমন ১১৬ জন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বিভিন্ন থানা এলাকায় অনুসন্ধান করে এই তালিকা করা হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের এসব ব্যবসায়ীদের গডফাদার এখন এখনও পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের নাম তালিকায় নেই। এসব তালিকা হালনাগাদ করার জন্য কোন আগ্রহ দেখায় না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। ২০১৫ সালে মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের এক তরল কোকেনের চালান ধরা পড়ে। খানজাহান আলী লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় বলিভিয়া থেকে একটি কন্টিনারে ১০৭ ড্রাম সানফ্লাওয়ারের তেলের মধ্যে দুই ড্রাম তরল কোকেন পাওয়া যায়। পরে ল্যাবরেটরি টেস্টে ও কোকেনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় বাংলাদেশ শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় দায়ের করা করা মাদক আইনের মামলাটি এখন আদালতে বিচারের অফেক্ষায় আছে। বাংলাদেশে কোকেন সর্ম্পকিত মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু দন্ড। ইয়াবা সর্ম্পকে এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশের মাদক চোরাচালান রুট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে এটি সব চাইতে বেশি ব্যবহার হচ্ছে।
২০১২ সালে ঢাকার শাহজালার আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে ২৬ কেজি ওজনের একটি হেরোইনের চালান ধরা পড়ে। এর কয়েক বছর আগে এই বিমান বন্দরে ২০ কেজি একটি হেরোইনের চালান এক ব্রিটিশ নাগরিক গ্রেপ্তার হন। এই মামলায় ব্রিটিশ নাগরিকের শাস্তি হয়। পরে সাধারণ ক্ষমায় মুক্ত হয়ে তিনি দেশে ফিরে যান।এলিয়েডা ম্যাকগর্ড নামের এই ব্রিটিশ তরণী ছিলেন হেরোইন বহনকারী। মূল পাচারকারীদের চিহ্নিত করা যায়নি। আর তখন মাদক চোরাচালানির আর্ন্তজাতিক রুট হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে।
মাদক দ্রব্য অধিদপ্তরেরর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১,০৬,৫৩৬টি। এই মামলাগুলো মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্ট গার্ডের অভিযোগ, আটক মাদক দ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাংলাদেশে বছরে ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৪০ হাজার কোটির মতো, প্রতিটির মূল্য দুইশত টাকা হিসাবে বাজার মূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। বাংলাদেশে মাদকের ব্যবহার কমছে না কেন? এই প্রশ্নে উত্তর সবার জানা । বাংলাদেশে মাদক দ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার বেশ বড়। যদি ব্যবসায়ী বলা হয় এ রকম ব্যবসায়ী পাঁচ হাজারের বেশি। সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৪১ জন। তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি আছেন। মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার। আবার কোন কোন মাদক সেবী খুচরা বিক্রেতা হিসাবে কাজ করেন। অন্য দিকে সারা দেশে ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে। আর ও একটি ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে যে, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার ৮৫ শতাংশ ভেজাল। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানান ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তার মধ্যে কিডনি, লিভার, ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন