আমাদের দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা, মাত্রা ও ব্যাপকতা উদ্বেগজনকভাবে দেখা দিয়েছে। গত ১২/১৩ই মে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুই দিনে দেশে বজ্রপাতে অন্তত ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা প্রায় ৪০ জন। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে ৪০ থেকে ৫০ বার বিদ্যুৎ চমকায়। এই হিসাবমতে, সারা বছরে প্রায় ১৪০ কোটি বার বিদ্যুৎ চমকায়। আবহাওয়াবিদদের মতে, প্রাকৃতিকভাবেই বায়ুম-লে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়ে মেঘে জমা থাকে। এই বিদ্যুৎ মেঘে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ হিসেবে থাকে। মেঘে অবস্থিত বিদ্যুৎক্ষেত্র যখন যথেষ্ট শক্তিশালী হয় (প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০ হাজার ভোল্ট), তখন তার আশপাশের বাতাস ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জে বিভক্ত হয়ে মেঘ ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের পথ বা শর্টসার্কিট তৈরি করে এবং বজ্রপাত ঘটায়। উন্মুক্ত ও বিস্তৃৃত স্থানে বজ্রপাত তড়িৎ চৌম্বকীয় আর্কষণ সৃষ্টি হয় বলেই হাওরাঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হয়। শহরের দালানকোঠায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা আছে, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তা নেই। বৈশাখ মাসে কৃষকেরা হাওরে ফসল কাটেন, ফলে তাদের খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে হয়। হাওরাঞ্চলে এ সময় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। বজ্রপাতের স্থায়িত্ব হয় এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ। ঠিক এই সময়েই বজ্রপাতের প্রভাবে বাতাস সূর্যপৃষ্ঠের পাঁচ গুণ বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রচ- শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। আদরের শোনামনি শিশুরা খুব ভয় পায়। ভূপৃষ্ঠের যে স্থানে বজ্রপাত হয়, তার ১৫ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে কেউ থাকলে তার মৃত্যু অনিবার্য। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তন এই প্রাকৃতিক ব্যাপারটির সংঘটন বাড়িয়ে দিয়েছে। অবিরাম খরা ও তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি, আবহাওয়া ম-লে নেতিবাচক পরিবর্তন, সাগর ও ভূ-পৃষ্ঠে উত্তাপ বৃদ্ধি-এসবই ঝড়-বজ্রপাতের প্রবণতা, সংখ্যা ও পরিধি বৃদ্ধির কারণ। বাংলাদেশে বজ্রপাত বাড়ার কারণও একই। বিশেষজ্ঞদের মত হলো, পূর্ণশক্তিতে একটি বজ্রপাত আঘাত হানলে তার শক্তিমাত্রা দাঁড়ায় হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার সমান। আর নিম্ন ক্ষমতার বজ্রপাতের শক্তিমাত্রা ৩৩ কেভি বৈদ্যুতিক শক্তির সমান। বর্ষা ছাড়াও কালবৈশাখীর সাথে কিংবা বছরের অন্য সময়েও কালো মেঘ ভরা আকাশে বিজলি চমকায় এবং এরপর বজ্র পড়ে। একেকটি বাজ বা বজ্রে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ থাকে। বজ্রপাতে মানবদেহ পুড়ে যায় কিংবা রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে প্রচ- উত্তাপে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে। সচেতনতা থাকলে বজ্রপাতে প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব। বিজলি চমকাতে থাকলে খোলা আকাশের নিচে না থেকে দ্রুত কোনো ঘরে আশ্রয় নিতে হবে। তবে গাছের নিচে অথবা বিদ্যুতের খুঁটির কাছে থাকা যাবে না। আবার খোলা জলভাগও নিরাপদ নয়। পুকুর, দীঘি, নদ-নদীতে বজ্রপাতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের প্রত্যেক বছর গড়ে ২৪ হাজার মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারায়। আহতের সংখ্যা এর ১০ গুণ, আহতদের ১০ থেকে ৩০ শতাংশের মৃত্যু ঘটে থাকে। ৮০ শতাংশ আহত ব্যক্তি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকেন। উল্লেখ্য, বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তি যে অবস্থায় এর শিকার হন, সাধারণত সে অবস্থায় স্থির থাকতে দেখা যায় মুত্যর পরেও। বর্ষা আসন্ন। এ সময়ে সর্বত্র বজ্রবৃষ্টি হবে এবং হচ্ছে বারবার। আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণী প্রচার করলেও জনগণকে তেমন সচেতনতা অবলম্বন করতে দেখা যায় না। কারণ বজ্রপাতের মতো ভয়াবহ বিপদ থেকে আত্মরক্ষার বিষয়ে স্পষ্টভাবে বা বিস্তারিত জানানো হয় না কারো পক্ষ থেকে। এসব নিয়ম-কানুন সরকার, এনজিও এবং মিডিয়ার উদ্যোগে ব্যাপকভাবে তুলে ধরা দরকার। প্রতি বছর বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণও জানানো উচিত। সব ভবনে ‘আর্থিং’-এর ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে শিক্ষক, ইমাম, খতিব, জনপ্রতিনিধি, মোড়ল-মাতব্বর, পরিবারের কর্তা সবারই দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। হাওরের প্রকৃতি ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষকেরা বলছেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে সবাইকে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি হাওরে ও খোলা জায়গায় উঁচু গাছ, বিশেষ করে তালগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে। এতে একদিকে যেমন বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, অন্যদিকে সবুজের সমারোহে ভরে উঠবে দেশ। বিষয়টির প্রতি সরকার দ্রুত নজর দিয়ে প্রয়োজনীয় কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসবে, এমন প্রত্যাশাই সকলের।
ষ ডা. মাও. লোকমান হেকিম
চিকিৎসক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন