ওয়াকফ এস্টেটগুলো মূলত জনস্বার্থে এবং আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত সম্পত্তি, যা ১৯৬২ সালের বাংলাদেশ ওয়াকফ আইন অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, দেশে ওয়াকফ আইন ও কাগজে কলমে একটি ওয়াকফ প্রশাসন সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও এসব আইন ও প্রশাসন ওয়াকফকৃত সম্পত্তি রক্ষায় তেমন কোনো কাজে আসছে না। গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের তালিকায় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে দেশে সাড়ে ৩ লাখ ওয়াকফ এস্টেটের মধ্যে ৩ লাখ ২৯ হাজারই বেদখল হয়ে গেছে। প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার একর ওয়াকফ জমির মধ্যে ১ লাখ ২২ হাজার একরই এখন বেদখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি বিভিন্ন সরকারি ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনার দখলে থাকা এসব সম্পদ ও জমি উদ্ধার, ক্ষতিপূরণ বা সম্পত্তির আয় ওয়াকফ শর্ত পালনে ব্যয় করার কোনো সরকারি বা আইনগত উদ্যোগ নেই বললেই চলে। দেশের জনপ্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয় এবং বঙ্গভবনের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অবকাঠামোগুলোও নাকি গড়ে উঠেছে মূলত ওয়াকফকৃত সম্পত্তির ওপর। ব্রিটিশ আমলে ধনাঢ্য সরকারি কর্মকর্তা জনৈক আইনউদ্দিন হায়দার এবং তার স্ত্রী ফয়জুন্নেসার করা ওয়াকফকৃত জমির পরিমাণ সাড়ে ১২ হাজার একর। আইনউদ্দিন এবং ফয়জুন্নেসার মতো আরো অনেক দানশীল ব্যক্তি সামাজিক উন্নয়নে হাজার হাজার একর জমি দান করে গেলেও এসব সম্পত্তির ৯০ ভাগই এখন বেদখলে রয়েছে বলে জানা যায়।
সরকার হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান যা সাংবিধানিক আইনের দ্বারা পরিচালিত হয়। সরকার নিজেই যদি আইন ভঙ্গ করে দখলবাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে দেশে প্রত্যাশিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে কিভাবে? বৃহত্তর স্বার্থে সচিবালয় বা বঙ্গভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওয়াকফকৃত জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোর স্বচ্ছতার স্বার্থেই তা আইনসিদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেহেতু ওয়াকফ এস্টেটের জমি ও সম্পত্তিগুলো জনস্বার্থে উৎসর্গিকৃত, এসব সম্পদ রক্ষা এবং এর আয়-ব্যয়ের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এক সময়ের ধনাঢ্য মুসলমানরা সারা ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে লাখ লাখ একর ব্যক্তিগত সম্পত্তি ইসলামিক ওয়াকফ এস্টেটের নামে দান করে গিয়েছিলেন। হাজার হাজার মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং গড়ে উঠেছে এসব জমিতে। তবে বেশির ভাগ অব্যবহৃত জমিই এখন প্রভাবশালীদের হাতে বেদখল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ মোতাওয়াল্লির যোগসাজশে জনস্বার্থে ওয়াকফকৃত জমিতে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত বাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। ভূমি জরিপ চলাকালে প্রভাবশালীরা সরকারি জরিপ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভুয়া কাগজপত্র ও দলিল সৃজন করে ওয়াকফ এস্টেটের জমি ব্যক্তিগত নামে রেকর্ড করিয়ে নিচ্ছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়।
শুধু ওয়াকফ এস্টেটের জমিই নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার একর জমি এখন প্রভাবশালীদের দ্বারা বেদখল হয়ে আছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে, গণপূর্ত বিভাগ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের হাজার হাজার একর জমি অবৈধ দখলে থাকার বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরও এসব সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। রেলওয়ের প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জমি প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দখল করে আছে বলে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরও এসব সম্পত্তি উদ্ধার ও সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রেলওয়েকে নিজস্ব সম্পদে সমৃদ্ধ ও সক্ষম করার উদ্যোগ না থাকা দুঃখজনক। জমি ও সম্পদের অবৈধ বেদখলের শিকার হওয়া সংস্থাগুলোর মধ্যে ওয়াকফ প্রশাসন সম্ভবত এক নম্বরে আছে। নিজস্ব সম্পদের ৯০ ভাগই বেদখলে থাকায় ওয়াকফ প্রশাসনের কর্মকা- ও দায়িত্বশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ। সাড়ে তিন লাখ ওয়াকফ এস্টেটের মধ্যে মাত্র ২১ হাজার এস্টেট তাদের দখলে রয়েছে। দখলে থাকা এস্টেটগুলোর আয়-ব্যয় ও পরিচালনায় নানাবিধ দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। শুধু নামমাত্র ওয়াকফ প্রশাসন জনগণের কাম্য নয়। জনস্বার্থে নিবেদিত সম্পত্তি জনকল্যাণে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে যা কিছু করণীয় তার সবই করতে হবে ওয়াকফ প্রশাসনকে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জনবল, আইনগত ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর দায়িত্ব। লাখ লাখ একর ওয়াকফ সম্পত্তি দখলমুক্ত করা সম্ভব হলে এসব হাজার হাজার কোটি টাকার জমি থেকে প্রাপ্য সম্ভাব্য আয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণে ব্যয় করা হলে তা সামাজিক উন্নয়নে বড় ধরনের মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। প্রভাবশালী মহলের হাত থেকে ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন