শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দমন পীড়ন সংকটকে তীব্রতর করবে

প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জঙ্গী ও সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে সোমবার পর্যন্ত গত চারদিনে ৯ হাজারেরও বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, এর মধ্যে জঙ্গী রয়েছে মাত্র ১১৯ জন। চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত বিএনপি’র ২১শ’র বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী  আহমেদ। এদিকে বিনা ওয়ারেন্টে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এমনকি সাদা পোশাকে এভাবে দৈনিক  হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারকে আইনের পরিপন্থী, অমানবিক বলে  মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনেরা। অনেক ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদলতে সোপর্দ করার বিধানও মানছে না পুলিশ। ফলে জনমনে উৎকন্ঠা বাড়ছে। এ সবের পিছনে ঈদের আগে  গ্রেপ্তারবাণিজ্য  ও বিরোধী দল দমনই  মুখ্য কারণ বলে তারা মনে করছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানও মনে করেন, এ ধরনের গণগ্রেপ্তারের ফলে নিরপরাধীদের নিপীড়নের শিকার হবার আশংকা রয়েছে। তিনি অতীত অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে বলেছেন, গ্রেপ্তার বাণিজ্যের আশংকাও অমূলক নয়। অবশ্য দেশব্যাপী জঙ্গী বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেপ্তার বাণিজ্য হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কেএম শহীদুল হক। গ্রেপ্তার বাণিজ্যের আশংকা করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়ায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সমালোচনা করেছেন তিনি। এই বাস্তবতায় নাটোরে মিলন হোসেন ও তার দু’বন্ধুর গ্রেপ্তার ও প্রাসঙ্গিক যে রিপোর্ট একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে তাতে গ্রেপ্তারের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয়।
বাস্তব অবস্থা হচ্ছে দেশের কারাগারগুলোতে ঠাঁই নেই। আগে থেকেই কারাগার বন্দীতে ঠাঁসা। তার উপর সারাদেশে চলমান পুলিশের বিশেষ অভিযানে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বন্দীর সংখ্যা। দৈনিক ইনকিলাবের খবরে বলা হয়েছে, গত রোববার পর্যন্ত দেশের ৬৮টি  কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭৩ হাজারেরও বেশি। অথচ এসব কারাগারে বন্দীর ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৩৪ হাজার ৭০৬ জনের। বলা হচ্ছে, এমনিতেই কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ বন্দী রয়েছে। তারপর আবার দুইদফা বিশেষ অভিযানের নামে একসঙ্গে এত লোক গ্রেপ্তারে কারাগারগুলোতে করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। কেন এই অভিযান তার বিশদ আলোচনা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থহীন। ধারাবাহিকভাবে চলমান টার্গেট কিলিং বন্ধ করার বিবেচনা থেকেই এ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে বিবেচনায় এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ যিনি বা যারা এ ধরনের কিলিংয়ে যুক্ত তাদের সুনির্দিষ্ট করে আইনের আওতায় আনা। প্রকৃতপক্ষে, যা ঘটছে তাহলো জনমনে বিশেষ করে বিরোধী মতের নাগরিকদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করা। এর মধ্যদিয়ে প্রকৃতকাজ কি হচ্ছে সে প্রশ্ন কোনমতেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সেই সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, প্রতি বছরই রোজার সময়ে ঈদের আগে কোন না কোনভাবে এক ধরনের পুলিশী অভিযান পরিচালিত হয়- যা নিয়ে নানা প্রশ্ন সবসময়ই রয়েছে। এবারেও অভিজ্ঞতার সূত্রধরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অনুরূপ আশংকা করলে পুলিশের প্রধান তার সমালোচনা করলেও গতকাল মঙ্গলবার একটি ইংরেজী দৈনিকে যে বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তারপর এ ধরনের অভিযানের প্রকৃতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ না করে কোন উপায় নেই। নাটোর সদরে সাতনি ইউনিয়নের  চেয়ারম্যান এবং নাটোর সদর উপজিলা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট তোফাজ্জল হোসেন নিজেই আলোচ্য দৈনিকটির কাছে বলেছেন, নির্বিরোধ শান্ত মিলন হোসেনের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে গেলে তার কাছে সংশ্লিষ্ট এএসআই ২০ হাজার টাকা দাবি করেছে এবং বলেছে, আপনি বলে এই টাকা, অন্য হলে আরো বেশি লাগত। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজ দোকান বন্ধ করে রাস্তায় থাকা অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময়ে মিলন ও তার বন্ধুদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, মিলনের মতো বাবুকেও পুলিশ তুলে নিয়েছে- যে নাকি তার পিতার ক্যান্সারচিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহে নিজ এলাকা থেকে নাটোর গিয়েছিল। তার চাচা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নাটোর সদর থানার ওসি তার মুক্তির জন্য ৮ হাজার টাকা দাবি করলে ৩ হাজার টাকার প্রস্তাব দিলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যদিও ওসি বলেছে, একথা ভিত্তিহীন। এধরনের অসংখ্য বিবরণ দৈনিকটিতে প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবতও হয়ত সারাদেশের চিত্র এক ও অভিন্ন। এ ধরনের অভিযোগে কার্যত কোন নতুনত্ব নেই। এর আগেও এ ধরনের অভিযানের সময়ে অনুরূপ অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, কথা-বার্তা যাই হোক পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। অন্যদিকে ভাববার রয়েছে সুপ্রীম কোর্ট থেকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার অসাংবিধানিক বলার পর খোদ স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী বলেছিলেন, সংশ্লিষ্টদের আদালতের নির্দেশ মানতে নির্দেশ দিয়েছেন। অলোচ্য ক্ষেত্রে যে তা মানা হচ্ছে না সে কথা দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও বিশিষ্টজনরাও বলেছেন।এহেন বাস্তবতায় অভিযানের ঘোষিত লক্ষ্য এবং তার সফলতা যে মারাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে তাতে কোন বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
চলমান হত্যা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে কোন মহলেরই কোন আপত্তি নেই। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল মহলই এ ধরনের হামলা বন্ধের উপরই জোর দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাও চলমান হত্যাকা-ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরাও মনে করি, এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। তার অর্থ এই নয় যে, জনমনে ভীতি সৃষ্টিকারী কোন পদক্ষেপ সমর্থনযোগ্য। অন্যদিকে এ ধরনের পদক্ষেপে কোন সুফল পাওয়ার আশা করাও বৃথা। এসব ক্ষেত্রে সফলতা পেতে এধরনের ব্যাপক গ্রেপ্তারের কোন নমুনাও বোধহয় পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে দেশে চলমান গুপ্ত হত্যাবন্ধসহ চলমান সংকট নিরসনে  রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন বলে বিশিষ্টজনেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা মনে করেন, শাসকদলের পক্ষ থেকেই এধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে ধাবিত হতে বাধ্য। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনশৃংখলা, ভীতি, আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে পর্যুদস্ত নিরীহ মানুষ বিনা দোষে পবিত্র রমজান মাসে পুলিশি হয়রানির শিকার হওয়ায় জনমনে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। সরকার যদি ইতিবাচক আলোচনা ও সমঝোতার পথে না গিয়ে দমনের পথ বেছে নেয়, তাতে সংকটের সমাধান হবে না বরং সংকট আরো বাড়বে। জঙ্গীদমন বা রাজনৈতিক সমাধান যাই বলা হোক না কেন মূল বিষয় হচ্ছে নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং জনমনে শান্তি স্থাপন। সংশ্লিষ্টরা যদি এ ব্যাপারে আন্তরিক ও যতœবান হোন তাহলেই প্রকৃত সমস্যার যৌক্তিক সমাধান সম্ভব।










 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন