হঠাৎ পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। দুর্দান্ত প্রতাপশালী দাপিয়ে বেড়ানোরা ‘থমকে’ গেছেন। ক্যাসিনোকান্ড, দখলদারিত্ব, হাউজি-জুয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বদলি বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানান অপকর্ম করে দুই হাতে টাকা কামাচ্ছেন; তারা হতোদ্যম। প্রতিবাদ দূরের কথা, দম্ভোক্তির কারণে সহকর্মী ও প্রতিবেশিরা যে ক্ষমতাধরদের সামনে মাথা তুলে কথা বলার সাহস পেতেন না; তারা গর্তে লুকিয়েছেন। এই দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার মূল কারণ ক্যাসিনো মাফিয়াচক্র, টেন্ডারবাজদের ধরতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) আর পুলিশের শুদ্ধি অভিযান।
অভিযান চালিয়ে টেন্ডার অধিপতি জি কে শামীম, ক্যাসিনো মফিয়া ইয়ংমেন্স ক্লাবের যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের কৃষকলীগ নেতা জুয়াড়ি শফিকুল আলম ফিরোজ গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান মাদক, স্বর্ণ, কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পর গেন্ডারিয়ায় যুবলীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপম ভুঁইয়ার সিন্দুক এবং তাদের কর্মচারীর বাসা থেকে যে পরিমান টাকা ও স্বর্ণ উদ্ধার করা হয় তা দেখে গোটা জাতি স্তম্ভিত। এতো টাকা এতো স্বর্ণ মানুষের বাসা-বাড়ির সিন্দুকে রাখে! দিল্লি অধিপতি সম্রাট শাহজাহান, সম্রাট আকবর, বাবর এমনকি বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ দৌল্লাহ’র স্ত্রী-কন্যারাও এতো স্বর্ণ দেখেননি এবং তাদের রাজকোষে এতো টাকা ছিল না।
রাজনীতিতে যত বিরোধ থাকুক না কেন র্যাব-পুলিশের চলমান শুদ্ধি অভিযানে প্রায় সব রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে। দেশে ‘সরকারের শুদ্ধি অভিযান’ এর পক্ষ্যে কার্যত জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে রাতের ‘ভূমিকা’ এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আজ্ঞাবহ ভুমিকা পালনের কারণে আইন শৃংখলা বাহিনীর ইমেজ তলানিতে। চলমান এই শুদ্ধি অভিযানের পর মানুষ র্যাব ও পুলিশকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা পর্যন্ত একই চিত্র। মানুষ আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছেন। ‘শুদ্ধি অভিযান’ সমর্থন দিয়েছে সেনাবাহিনীও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর পোস্ট-লাইক-শেয়ার-মন্তব্য দেখলে বোঝা যায় মানুষ কত খুশি। কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনীরও উচিত মানুষের এই সমর্থন ধরে রাখা। সঠিক তথ্যের ভিক্তিতে প্রকৃত অপরাধীর গ্রেফতার সবাই চায়। নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিক্তিতে চক্রের বাসা-অফিস-আস্তানায় তল্লাসী দেখতে চায়। চলমান শুদ্ধি অভিযানের কারণে সাধারণ মানুষ এবং নিরীহরা যাতে হয়নারির শিকার না হন সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য। জনমনে ভীতি সমাজে অশান্তি এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, নতুন করে আতঙ্ক-উৎকন্ঠার জন্ম নেয় সেটা কাম্য নয়। এমনিতেই দেশের অর্থনীতি স্থবির। দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতি এবং বিনিয়োগে ভাটা। সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে যত না আলোচনা তার চেয়ে বেশি বিতর্ক মেগা প্রকল্পের ‘কমিশন বাণিজ্য’ নিয়ে। পাবনার বালিশ কান্ড, ফরিদপুরের পর্দা ক্রয় কান্ড, রংপুরের হাসপাতালের মেশিন ক্রয়, চট্টগ্রামের পুকুর কাটার জন্য সরকারি কর্মচারীদের বিদেশে ট্রেনিং, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা চুরি ইত্যাদির কারণে মানুষ আস্থাহীন। সে অবস্থায় ‘ক্যাসিনো মাফিয়া’ এবং ক্ষমতাসীন দলের বিতর্কিতদের গ্রেফতার অভিযানে নিরীহদের হয়নারি, নাজেহাল কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
ইতোমধ্যেই মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে রাজধানী ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়া ছাড়াও গুলশান, কমলাপুর, বনানী, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ অনেক এলাকার ক্লাব, বাসা, এপার্টমেন্টে ক্যাসিনোর খেলা হচ্ছে। এমনকি অনেকেই নিজের ফ্লাটেও ক্যাসিনো খেলার আয়োজন করেন গোয়েন্দারা এমনও তথ্য পেয়েছেন। আবার হালে ক্যাসিনো পল্লী হিসেবে পরিচিত মতিঝিল ক্লাব পাড়ার পাশেই আরামবাগ আবাসিক এলাকা। ক্যাসিনোর মাফিয়াদের ধরতে বা ক্যাসিনোয় অভিযানের সময় নিরপরাধ মানুষের অফিস-বাসা-ফ্লাটে যেন ভুলক্রমে অভিযান চালানো না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা আবশ্যক।
চলমান অভিযান নিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত নয়, বরং খুশি। মানুষ দেখতে চায় অভিযান অব্যহত থাকুক এব মাফিয়া চক্র গ্রেফতার হোক। পুলিশ তাদের মুখোশ খুলে দিক। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য, আইন শৃংখলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে অযথা হয়নারীর ভয় আছে। কারণ কেউ শত্রুতাবশত ভুল তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে হয়রানী করতে পারে; আবার ব্যাক্তিগত শত্রুতার জের ধরেও প্রতিশোধ নিতে পুলিশকে ‘মিথ্যা তথ্য’ দিয়ে হয়রানি করাতে পারেন। এমন ঘটনা রাজনীতি এবং সমাজে অহরহ ঘটছে। তাই ‘চলমান শুদ্ধি অভিযানে’ আইন শৃংখলা বাহিনীকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। খবরে প্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতোমধ্যেই ক্যাসিনো মাফিয়াদের ভিডিও জমা দেয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, জুয়াসহ সমাজ বিরোধী অবৈধ পথে কারা জড়িত, কারা টাকার পাহাড় গড়ছেন তাদের সবার তথ্য আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে রয়েছে। এ ছাড়াও বিকাশমান প্রযুক্তির সাহায্যে প্রকৃত তথ্য জানা বা সংগ্রহ করা অসম্ভব কিছু নয়। আর কারা অপকর্মে জড়িত সে সম্পর্কে তথ্য উপাত্তের ভিত্তিকেই আইন শৃংখলা বাহিনী অভিযানে নেমেছে এটা মানুষের বিশ্বাস। কাজেই এসব ‘অপকর্ম নির্মূল অভিযান’ যেন হয় সঠিক যায়গায়, প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে। নিরীহ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন। ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় থেকে বিচার ব্যবস্থায় প্রচলিত বাণী, ‘আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে দশজন দোষী ব্যক্তি বের হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়’। এটা মনে রাখা জরুরী।
মানুষ সামাজিক জীব। ধনী-গরীব সব শ্রেণীর মানুষকে সমাজে মান-ইজ্জত নিয়ে বসবাস করতে হয়। আর ঢাকা শহর পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। এখানে এক বিল্ডিং এ শত-শত মানুষ বসবাস করেন, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য করেন অথচ কেউ কাউকে চেনেন না। পাশের রুমে কেউ মারা গেলে সে খবর রাখেন রাখেন না অন্য রুমে বসবাসকারী। একই মহল্লায় বসবাস করে হাজার হাজার মানুষ। ক্যাসিনো গড় ফাদার, মাফিয়াচক্র ধরতে আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে এই বাস্তবতা মাথায় রাখা উচিত। নিরীহ কেউ হয়রানীর শিকার হয়ে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হোক তা মোটেই কাম্য নয়। কারণ যেসব এলাকায় ক্যাসিনো খেলা হয় বলে আইন শৃংখলা বাহিনীর কাছে তথ্য এসেছে সে সব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। এক বিল্ডিয়ের পাশের ফ্লাটে কি হয় বোঝার উপায় নেই। হয়তো একই বিল্ডিং এ একযুগ ধরে বসবাস করছেন অথচ অন্য ফ্লাটের অপকর্মের খবর জানেন না। আইন শৃংখলা বাহিনীর উচিত সঠিক তথ্যের ভিত্তিকে ওই বিল্ডিংয়ের অপকর্মের ফ্লাটেই অভিযান চালানো। নিরীহদের যেন হয়রানীতে পড়তে না হয়। পাড়া-মহল্লার ক্ষেত্রেও এই পন্থা অবলম্বন আবশ্যক। ভুল তথ্যের ভিত্তিকে নিরপরাধ কারো বাসায় পুলিশ অভিযান চালালে তার যেমন সামাজিক মর্যাদা হানি ঘটে; তেমনি ওই বাসা কেউ ভাড়া নিতে চায় না। আবার ভুলক্রমে কোনো ভাড়াটের ফ্লাটে অভিযান চালালে ওই ভাড়াটে ব্যাক্তিকে বাড়ির মালিক বের করে দেন। সমাজের এই বাস্তবতা মেনেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। তাতে কারো কিছু আসে যায় না। কিন্তু নিরীহ ও নিরপরাধ কেউ হয়রানি হলে সামাজিক ভাবে তিনি হেয় প্রতিপন্ন হন। এটা মোটেই কাম্য নয়।
শুদ্ধি অভিযানে রাস্তাঘাটে যাতে নিরীহরা হয়রানির শিকার না হন সে দিকেও নজর দিতে হবে। অপরাধীদের ধরতে নিরপরাধ মানুষের গাড়ি থামানো, অযথা জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়নারী কাম্য নয়। আইন শৃংখলা বাহিনীর বাস, ট্রেন বা বিমান যাত্রীদের ক্ষেত্রেও একই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ইতোমধ্যেই ‘ক্যাসিনো’ ভিডিও তথ্য প্রকাশ হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যাসিনো মাফিয়াদের বসবাস। যাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলছে তারাসহ বিতর্কিত ব্যাক্তিদের তথ্য-উপাত্ত আইন শৃংখলা বাহিনীর নখদর্পনে। কারো ক্ষেত্রে তথ্যের ‘ঘাটতি’ ‘অসংগতি’ বা ‘সন্দেহ’ থাকলে তা যাচাই-বাছাই করে অভিযান চালানো উচিত। ক্যাসিনো মাফিয়াদের কেউ পালিয়ে বিদেশ গেছে, কেউ পর্দার আড়ালে থেকে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিতর্কিত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং পালিয়ে যাওয়ার চেস্টা করছেন; বিমানবন্দরে তাদের ‘পাকড়াও’ কঠিন কিছু নয়। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আইডি কার্ড প্রথা চালু হওয়ায় প্রকৃত ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা অতি সহজ। যাদের নাম ভিডিও ফুটেজ ও তালিকায় রয়েছে তারা পালাতে গেলে অনায়াসে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে ধরা পড়বেন। কিন্তু ক্যাসিনো চক্র, ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, লুটপাট,দখলদার গড়ফাদার, সন্ত্রাসি-মন্তানদের পাকড়াও করতে বিমানবন্দরে অন্যান্য যাত্রীরা যাতে হয়রানীর শিকার না হন সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
টানা সাড়ে ১০ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এ সময় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। মানুষের যাপিত জীবনে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের পথে। এই সময়ে মেগা প্রকল্পের ‘কমিশন বাণিজ্য’ অভিযোগ যেমন উঠেছে; তেমনি শত শত কোটি টাকা বিদেশ পাচার হয়েছে। চোখের সামনে যারা রিক্সায় চলাচল করতেন, তাদের অনেকেই প্রাডো গাড়ি হাকান। দুই রুমের বাসা ভাড়া দিতে পারতেন না; তারা গুলশান-বনানী-বারীধারা-উত্তরায় ফ্লাটে বিলাসী জীবন যাপন করেন। শুদ্ধি অভিযানে আইন শৃংখলা বাহিনী যেখানে অভিযান চালাচ্ছেন সেখানে পাচ্ছে টাকার খনি, সোনার খনি। আইন শৃংখলা বাহিনীর এই সাফল্যের চিত্র মিডিয়ায় দেখে মানুষ ‘বাহবা’ দিচ্ছেন। কাজেই এই অভিযান যেন পজেটিভ ভাবে অব্যহত থাকে। সমাজে, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, নিরপরাধ মানুষের উদ্বেগ-ভীতি সৃষ্টি হয়; এমন পরিস্থিতি কাম্য নয়। শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকুক এবং দেশ হোক ক্যাসিনো মাফিয়াচক্র মুক্তি। মুসলিম দেশে প্রকাশ্যে ক্যাসিনো ব্যবসা কারোই নয়। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন