‘ক্যাসিনো’ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। মতিঝিলের ক্লাবপাড়া এবং যুবলীগ, কৃষক লীগের কয়েকজন নেতার বাসায় অভিযানে কোটি কোটি টাকা এবং স্বর্ণ উদ্ধার করায় ‘শুদ্ধি অভিযান’ কার্যত আলোচনার শীর্ষে। কিন্তু কিছু অভিযানে বাসা থেকে মদ উদ্ধার, ক্লাব থেকে মদ-তাস উদ্ধার নিয়ে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক উঠতে শুরু করেছে; প্রশ্নটা এমন যে, শুদ্ধি অভিযান কী সত্যিই চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে; নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে? ইতোমধ্যেই ‘শুদ্ধি অভিযান’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রবীণ নেতা রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী এই শুদ্ধি অভিযান চমক সৃষ্টি করবে কিন্তু সমাধান করতে পারবে না’।
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরি একা/ আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা/ বাহিরে অন্তরে ঝড় উঠিয়াছে/...’। জাতীয় কবির এই পাখির মতো চলমান শুদ্ধি অভিযান পথহারা হোক মানুষ সেটা চায় না। আবার অভিযানের নামে সমাজে ভীতি-আতঙ্ক সৃষ্টি হোক সেটাও চায় না। মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হলে তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে যা কারো জন্যই সুখকর নয়। উল্লেখ- করা প্রয়োজন যে, দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে সমাজের কিছু ব্যক্তিকে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করায় রাষ্ট্রের দুর্নীতিবিরোধী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
মানুষ সামাজিক জীব। আদিকাল থেকে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে অভ্যস্ত। আবার গ্রাম, শহর, দেশ থেকে দেশান্তরে মানুষের সমাজে যাপিত জীবনে রয়েছে ভিন্নতা। মসজিদ কেন্দ্রীক সমাজব্যবস্থা এক ধরণের, শহরে ক্লাবপাড়া কেন্দ্রীক সমাজব্যবস্থা আরেক রকম। এ ছাড়াও চরের জীবন, মফস্বল শহরের জীবন, সাগরপাড়ের জীবন ভিন্ন ভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে।
শহরে জীবনে মানুষ নানানভাবে বিনোদন উপভোগ করেন। কেউ সিনেমা দেখে, কেউ খেলাধুলা করে, কেউ পড়াশোনা করে, কেউ আল্লাহর পথে সময় ব্যয় করার মধ্যে নিজেদের বিনোদন খুঁজে নেন। দেশে ক্রীড়াঙ্গন কেন্দ্রীক অসংখ্য ক্লাব গড়ে উঠেছে। এসব ক্লাব খেলাধূলার প্রশিক্ষণ, অংশগ্রহণ এবং খেলাধুলার উন্নয়নে কাজ করে। এই ক্লাবগুলোতে হরেক রকমের মানুষের যাতায়াত। তাই ক্লাবগুলোয় তাস খেলা, মদ পান কোথাও কোথাও হাউজি ইত্যাদি হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ক্লাব, হোটেলে সরকার আইন করে মদ পানের ব্যবস্থা করেছে। মদ বিক্রি ও পানের জন্য লাইন্সেসও দেয়া হয়। মদ আমদানির মাধ্যমে প্রতিবছর সরকার কোটি কোটি টাকা শুল্ক আয় করে থাকে। ঢাকার ক্লাবগুলোর ভেতরে এই মদ পান ওপেন সিক্রেট। ক্লাবের ভেতরে মদ পান পাবলিক লুইন্সেসির করার সুযোগ নেই। ক্লাবের ভেতরে ‘মসজিদের পরিবেশ’ প্রত্যাশা কেউ করে না। কিন্তু ক্লাব থেকে তাস-মদ উদ্ধারের যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা দেখে অনেকেই আশঙ্কা করছেন ‘শুদ্ধি অভিযান সঠিক পথে চলাবে তো’?
ক্যাসিনো খেলা অপরাধ, অপরাধ ইয়াবা কারবার ও সেবক। এমনকি জুয়াও অবৈধ। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসা-সেবনের সঙ্গে ক্লাবে ও হোটেলে বসে মদ পান এক করে দেখলে চলে না। ঘরে বসে মদ পান নিষিদ্ধ হলে সরকার লাইন্সেস দিতো না। ক্লাব-বারে কী হয় সবার জানা। শুধু মতিঝিলের ক্রীড়াঙ্গনের ক্লাব নয়, রাজধানী ঢাকা শহরে শত শত ক্লাব রয়েছে। ঢাকার বাইরেও রয়েছে শত শত ক্লাব। ক্লাব সংস্কৃতি কী তা সবার জানা। রাজধানীর কয়টা ক্লাব খুঁজে পাওয়া যাবে যে সেখানে মদ পান ও তাস খেলা হয় না। সেখানে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে কি না সেটাই দেখার বিষয়। ‘ক্যাসিনো’ খেলা আইনত দ-নীয় অপরাধ। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যহত থাকুক এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সবাই প্রত্যাশা করে। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো বলেছেন, ‘ক্যাসিনোর টাকা যাদের নিয়ে থাকেন তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি কী প্রত্যাশিত? তাহলে তো ‘লোম বাছতে কম্বল উজার’ হয়ে যাবে।
মদ নেশা জাতীয় জিনিস। মদ পান ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না। নবী করিম (সা:) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নেশার বস্তুই মাদক (খামার) আর প্রত্যেক নেশার জিনিসই হারাম’ (মুসলিম-২০০৩)। ‘যা অধিক সেবন করলে নেশার সৃষ্টি হয় তা কম সেবন করাও হারাম’ (তিরমিযি-১৮৬৫, আবু দাঊদ-৩৬৮১)। বাস্তবতা হলো ঠা-ার দেশ ইউরোপ আমেরিকায় নাগরিকের ‘মদ পান’ স্বাভাবিক ঘটনা। ক্লাব কালচার, পর্যটন ব্যবসার জন্য মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোর ক্লাব ও হোটেলে ‘মদ পান’ হয়ে থাকে। হোটেলে বা ক্লাবে মদ পান করে পথে প্রান্তরে পাবলিক লুইন্সেসি না করলেই হলো। বিসিসি’র এক সদস্যকে গ্রেফতারের সময় বাসা থেকে মদ উদ্ধার করা হয়েছে। অথচ বিসিসির সভাপতি নাজমুল হক পাপন ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, ‘উনি জীবনে মদ স্পর্শ করেননি, জুয়া খেলেননি’। প্রশ্ন হলো- গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরাসহ অভিজাত এলাকা ও ফ্ল্যাটে বসবাস করেন হোটেল-ক্লাব কালচারে জড়িত এমন কতজন মানুষ পাওয়া যাবে যে তাদের বাসায় মদের বোতল পাওয়া যাবে না?
বাংলাদেশে পর্যটন ব্যবসার প্রসারে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ষষ্ঠ বৈঠকে পর্যটন ব্যবসা বিকাশে মদের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কাজী ফিরোজ রশীদ, তানভীর ইমাম, আশেক উল্লাহ রফিক এবং সৈয়দা রুবিনা আক্তার অংশ নেন। বৈঠকে দেশের প্রতিটি পাঁচতারা হোটেল ও নাইটক্লাবে বিয়ার ও হার্ড ড্রিংকসে (মদ) মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এই প্রস্তাবনা খুবই যৌক্তিক। পর্যটন শিল্প থেকে আয় করতে হলে এ ধরণের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। আবার মানুষ চায় ক্লাবে ‘ক্যাসিনো’র বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকুক। যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। কারা ক্যাসিনো খেলেন, কারা ক্যাসিনো আমদানি করেছেন, কারা টাকার ভাগবাটোয়ারা নেন সবকিছু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নখদর্পণে। ক্যাসিনো সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেয়েই প্রধানমন্ত্রী শুদ্ধি অভিযানের নির্দেশনা দিয়েছেন। কাজেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত ‘ক্যাসিনো’ জুয়ার মূলোৎপাটন করা। কিন্তু ক্লাবগুলো বন্ধ হয়ে যায় এমন তৎপরতা প্রত্যাশিত নয়। কারণ মানুষের বিনোদনের এমনিতেই জায়গা নেই। ক্লাবে খেলে, খেলা দেখে এবং সময় কাটানোর মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিনোদন খুঁজে নেন।
আগেই বলেছি ক্লাবের ভেতরে মসজিদের পরিবেশ প্রত্যাশা করা উচিত নয়। ক্লাব কালচার এবং ক্লাব পরিচালনা প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলছেন, ‘ক্লাবের ফুটবল-ক্রিকেটে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে অনেক খরচ লাগে। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান ঠিক আছে। তাস খেলায়ও ঢালাও অভিযান গ্রহণযোগ্য নেই। ক্লাবে প্রতিবছর যে খরচ হয় তা কি কেউ দেয়?’ অনেকের কাছে এই বক্তব্য অপ্রিয় হলেও বক্তব্যের কী যথার্থতা নেই?
এটা ঠিক দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও দলটির অঙ্গ সংগঠনগুলোর কিছু নেতা হঠাৎ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে গেছেন। দল ক্ষমতায় থাকায় প্রভাব খাটিয়ে, বৈধ-অবৈধ পথে অর্থবিত্ত আয় করেছেন। নতুন করে টাকা হওয়ায় সমাজে নতুন শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তাদের নতুন আকাক্সক্ষা, কাচা টাকার গরমে সীমাহীন অনাচারী-অপচয়ে জীবনধারাও হয়ে গেছে অনিয়ন্ত্রিত। জীবনধারায় পচনশীল ওই যুবক ও তরুণরা ‘ক্যাসিনো’ অনাচারে নিমজ্জিত। কারা জড়িত তাদের নাম ওপেন সিক্রেট। যুবলীগের যে সব ক্যাসিনো গডফাদারদের গ্রেফতার করা হয়েছে; জিজ্ঞাসাবাদে তারা সব প্রকাশ করেছেন। তাহলে শুদ্ধি অভিযানের নামে সাধারণ মানুষকে ভীতির মধ্যে ফেলতে হবে কেন? এমনিতেই দেশের অর্থনীতি নানা চাপের মুখে। দ্রব্যমূল্য মানুষকে দিশেহারা করে ফেলেছে। মানুষ ভাল নেই। নির্বাচনে ভোট দিতে না পারায় মানুষের মধ্যে অস্বস্থি রয়েছে। তারপর তারপরও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে মানুষ খুশি। কিন্তু অভিযানের নামে মানুষকে বিব্রত করা যেমন উচিত নয়; তেমনি কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের মতো অভিযানের সময় বাসায় দুই বোতল মদ, ক্লাবে মদ-তাস উদ্ধারে সাফল্য খোঁজা অনর্থক। আমাদের কথা হলো মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়াদি এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কর্ম প্রত্যাশিত নয়; তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘শুদ্ধি অভিযান’ অব্যাহত থাকুক এবং আলোচিত অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক সে প্রত্যাশা রইলো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন