বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ক্যাসিনোয় জড়িতদের ঠেকাতে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা

মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে শামীম-খালেদ-ফিরোজ

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম

অবৈধ ক্যাসিনো চালানো, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার জি কে শামীম, খালেদ ও ফিরোজকে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ ও চাঁদা দেয়া সম্পর্কে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে ওই তিনজন। খালেদ ও জি কে শামীম জিজ্ঞাসাবাদে যে সব তথ্য দিয়েছে তার ভিত্তিতে একটি তালিকা তৈরি করেছে একটি সংস্থা। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের দেশত্যাগ ঠেকাতে এরই মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেনাপোল সীমান্তসহ দেশের সকল ইমিগ্রেশনে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

অন্যদিকে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের গ্রেফতার নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে সম্রাটের অবস্থান নিয়ে রীতিমত বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কেউ বলছে সম্রাট গ্রেফতার হয়েছে, কেউ বলছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সম্রাট প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সেল্টারে রয়েছে। তবে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সম্রাট গ্রেফতার কি না তা দ্রুত জানতে পারবেন। দেখবেন আপনারা খুব শিগগিরই দেখবেন। র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, জি কে শামীম ও খালেদকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শামীমের টেন্ডারবাজির প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে খালেদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। খালেদ ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া কোম্পানি’র নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার জমা দেয়ার পর ওই টেন্ডার নেগোশিয়েট করেন জি কে শামীমের জি কে বিল্ডার্সের সঙ্গে। একই সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের কমিশনের নামে চাঁদার টাকা দেয়া হতো।

সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা
বেনাপোল অফিস জানান, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে বেনাপোল সীমান্তসহ পুলিশ ইমিগ্রেশনে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সতর্কতার বিষয়টি বেনাপোল ইমিগ্রেশন ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন। ইমিগ্রেশনের ওসি মহসিন খান পাঠান জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেনাপোল ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত পথে বিভিন্ন কৌশলে তারা ভারতে পালিয়ে যেতে পারে। ফলে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও পুলিশ ইমিগ্রেশনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

বেনাপোল ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত এলাকা ঘুরে পুলিশ ও বিজিবি’র এ নজরদারি ও সতর্কতা চোখে পড়ে। ইমিগ্রেশনে ভারতগামী পাসপোর্টধারী যাত্রীদের নাম, ঠিকানা যাচাই ও পাসপোর্টের সঙ্গে তাদের ছবি মিলিয়ে দেখা হচ্ছে সতর্কতার সাথে। এছাড়া একাধিক বা জাল পাসপোর্ট যাতে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য যাত্রীর ছবি তোলাসহ ও হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো ভাবেই যাতে অবৈধভাবে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারেন সে জন্য সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়িয়েছেন।

বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি মহাসিন খান পাঠান আরো জানান, ঢাকা পুলিশের এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) থেকে তাদের কাছে একটি নির্দেশনা এসেছে। যুবলীগের ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও ৯ নেপালের নাগরিক যাতে কোনোভাবেই দেশ ত্যাগ করতে না পারেন তার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন নতুন নতুন আরও নামের তালিকা আসছে বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবির ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সেলিম রেজা ও ২১ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ঘোষিত অপরাধীরা যাতে কোনোভাবে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারতে পালাতে না পারেন সে সীমান্ত এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

জড়িতদের গ্রেফতার নেই
পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগের দুই নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার মালিকানাধীন ৫ কোটি টাকা ও স্বর্ণালংকার উদ্ধারের ঘটনায় তিন থানায় সাতটি মামলা হলেও গতকাল শনিবার পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক তথ্য পাওয়া গেলেও সেই তথ্য অনুযায়ী জড়িতরা গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। এছাড়া মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। খালেদ ও জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে জড়িত র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজি সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের সখ্যতার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জি কে শামীম ও খালেদ কারো সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে কি না সে বিষয়েও সতর্ক রয়েছেন তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা।


জানা যায়, জিকে শামীমের সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে ব্যবসা আছে। সিঙ্গাপুুরে দুটি ফ্ল্যাট থাকার ব্যাপারে তথ্য পেয়েছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তাছাড়া আমেরিকা ও সৌদি আরবেও তার ব্যবসা আছে। যুবলীগ নেতা নুরুরননবী ওরফে রাজু সৌদি আরবের রিয়াদে সোনার ব্যবসা করছেন। সেখানে তার বেশ কয়েকটি দোকান আছে। রাজু এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে আছেন। খালেদ মাহমুদের অন্যতম সহযোগী রাজু। রাজু টেন্ডারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। সিঙ্গাপুরে যুবলীগ দক্ষিনের এক শীর্ষ নেতা গত ১০ বছরে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা পাচার করে ব্যবসা চালাচ্ছেন। আর তার ব্যবসা দেখাশুনা করেন চীনা নাগরিক সিন্ডি লি। তিনি মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে আসতেন। এবং একটি পাচতারা হোটেলে থাকতেন। ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিমুল হক সাঈদের সিঙ্গাপুরে ব্যবসা আছে। আছে একটি ফ্ল্যাট। ওই ফ্ল্যাটে তিনি থাকেন। এক সময় সাঈদ মতিঝিল এলাকায় চোরাই তেলের ব্যবসা করতেন। অভিযান শুরুর দুইদিন আগেই সিঙ্গাপুর পালিয়ে যান সাঈদ।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান চালানো হয়। এই সময়ে ৩২টি অভিযান খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নগদ ১৭ কোটি টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর এবং ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। তাছাড়া ওইসব অভিযানে ২০১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, যুবলীগের শীর্ষ নেতার নিয়ন্ত্রণে চলা ক্যাসিনো কারবার থেকে শুধু চাঁদা তোলার কাজ করে এক সময় কাকরাইলের বিপাশা হোটেলের বয়ের কাজ করা জাকির হোসেন ও গুলিস্তানের হকার আরমান কোটি টাকার মালিক। নতুন মডেলেরে হ্যারিয়ার গাড়ি দাপিয়ে চাঁদা তুলতেন আরমান। দুটি ক্যাসিনোর মালিকানাও রয়েছে তার। কোন ক্যাসিনোর চাঁদার পরিমান কত হবে যুবলীগের শীর্ষ নেতার সাথে বসে তার পরিমানও ঠিক করে দিতেন আরমান। আর জাকির চাঁদা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় মাসোয়ারা পৌছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। ক্যাসিনো ও ক্লাবপাড়ার সবাই তাদের ওই নেতার বন্ধু হিসেবেই চেনেন। সিঙ্গাপুরে অভিজাত ক্যাসিনো মেরিনা বে’তে গিয়ে তারা জুয়াও খেলেন একসাথে। পুলিশ জানায়, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় এক সময় ওয়ান টেন ও থ্রি কার্ডের মত জুয়া চলত। যুবলীগের শীর্ষ নেতার নিয়ন্ত্রণেই মুলত ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব ও ভবনে বিদেশের আদলে অবৈধ ক্যাসিনো গড়ে উঠতে থাকে। আর এ খাত থেকে প্রতিদিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও কিছু গনমাধ্যম কর্মীর নাম করে মোটা অংকের চাঁদা উঠানো হয়। টাকার লোভে পড়ে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে ক্যাসিনা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন