দেশজুড়ে শুরু হওয়া পুলিশের জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে ভুলবার্তা যাচ্ছে বহির্বিশ্বে। বিপুল সংখ্যায় গ্রেফতারের ফলে এই প্রশ্ন উঠেছে যে, তবে কি দেশে ব্যাপক জঙ্গি উত্থান ঘটেছে? এ রকম বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার পুলিশকে কড়া সতর্কবার্তা দিয়েছেন বলে একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে। অভিযানে একজন নিরীহ মানুষ ধরা হলে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা তিনি বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন বার্তাটি তিনি মহাপুলিশ পরিদর্শককে জানিয়ে দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, গ্রেফতারের সংখ্যাটি অনেক বড়। কারণ, এর মধ্যে অনেক মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী বা সমাজের বিভিন্ন ধরনের অপরাধী রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, গত ১০ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত মোট গ্রেপ্তার ১১ হাজার ৬৮৪ জন। এদিকে পুলিশ সদর দফতর থেকে বলা হয়েছে, জনমনে ভীতি কমাতে ও সচেতনতা বাড়াতে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। বলা হয়েছে, সম্প্রতি জঙ্গিদের হাতে বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ের ঘটনায় জনমনে কিছুটা আতঙ্ক বা ভীতি বিরাজ করছিল। এই প্রেক্ষাপটেই সবাইকে জানান দিয়ে দেশব্যাপী জঙ্গি দমনে বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়। গ্রেফতারকৃত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও মামলা রয়েছে। পাশাপাশি জঙ্গি অভিযানকালে অন্যান্য মামলার আসামিরাও গ্রেফতার হচ্ছে।
সাঁড়াশি অভিযানের নামে কি হচ্ছে তার বিশদ বিবরণ ইতোমধ্যেই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা যতই সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলুন না কেন এ অভিযানে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে পুলিশের এক ধরনের গ্রেফতার বাণিজ্য। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অভিযানে আটক হাজার হাজার অতিরিক্ত বন্দীর চাপে কারাগারগগুলোতে কোনো ঠাঁই নাই। কারা কর্তৃপক্ষও হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। ইতোমধ্যেই বন্দীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় কারা অভ্যন্তরে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে গণগ্রেফতার জনমনে ভীতি কমানোর পরিবর্তে ভীতিসঞ্চার করে চলেছে। গত ক’দিনে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কিভাবে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে দেশের কোন কোন অঞ্চলের নির্দোষ নিরপরাধীদের গ্রেফতার এবং এনিয়ে চাঁদাবাজি চলছে তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিকটির রিপোর্টে স্পষ্ট করা হয়েছে কিভাবে শত্রুতা ও নানা ধরনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে চলমান সাঁড়াশি অভিযান। এই অভিযান শুরুর আগেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অনুরূপ আশংকা ব্যক্ত করায় পুলিশের আইজিপি তার সমালোচনা করে বলেছিলেন কোন প্রকার চাঁদাবাজি হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, চলমান অভিযানে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। দরিদ্র মানুষেরা গ্রেফতারকৃত স্বজনদেন ছাড়িয়ে আনতে শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অভিযানে ধরা পড়ায় পরিবারগুলো অসহায় অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশের বিশিষ্টজন ও আইনজীবীরা স্পষ্ট করে বলেছেন, এ ধরনের গ্রেফতারের পেছনে কোন আইনগত ভিত্তি নেই। প্রকৃত বিবেচনায় অভিযানের যে লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে তার সাথে গণগ্রেফতারেরও কোন সম্পর্ক নেই। ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও পারদর্শিতা প্রয়োজন তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, এর ফলে মূলকাজ কিছুই হচ্ছে না বরং জনভোগান্তি আরো বেড়েছে এবং বাড়ছে।
ঘোষিত জঙ্গি দমনের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট। এ নিয়ে ঢাকঢোল পেটাবার কিছু নেই। তবে অভিযানের নামে যে গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে হয়রানী করা হচ্ছে তা এখন স্পষ্ট। এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান কাম্য হতে পারে না। যে অভিযান নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং তা জনগণের চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এ ধরনের অভিযান কোনাভাবেই চলতে দেয়া যায় না। জননিরাপত্তার অভিযান যদি জনভীতিকর হয়ে উঠে তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ধরনের অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি শ্রেণীর লাভ হলেও সরকারের মূল লক্ষ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠে। এবারের সাঁড়াশি অভিযানে তা-ই পরিলক্ষিত হয়ে উঠেছে। সাঁড়াশি অভিযান মানে দাগী ও প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়বে। নিরীহরা রেহাই পাবে এবং জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে। আমরা দেখছি সাঁড়াশি অভিযানের নামে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে ধরা হচ্ছে। এসব গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পুলিশের একটি শ্রেণী ভয়ভীতি দেখিয়ে বাণিজ্য করে চলেছে। নিরূপায় স্বজনরা যা আছে তা বিক্রি করেই পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। এ যেন আরেক মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি, এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ অভিযান বন্ধ করুন। পবিত্র রমজান ও ঈদের আগে যেকোন অবস্থাতেই চলমান গণগ্রেফতার বন্ধ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন