শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভারতের অনুকূলে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট

প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ-ভারত স্থল ও নৌ-ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। পূর্বঘোষিত সিডিউল অনুসারে ভারতীয় ইস্পাত বোঝাই একটি জাহাজ কলকাতা থেকে ত্রিপুরার উদ্দেশে যাত্রা করে গতকাল আশুগঞ্জ নদীবন্দরে অবতরণ করে। আজ (বৃহস্পতিবার) নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের আশুগঞ্জ বন্দরে পণ্য খালাসের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিট উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এই ট্রানজিট ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে ভারত সরকার এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প খরচে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করার সুযোগ লাভ করল। এমনিতে যেখানে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি দিয়ে আগরতলায় প্রতিটন পণ্য পরিবহনে ৬৭ মার্কিন ডলার খরচ পড়ে এবং ৩০দিন সময় লাগে, সেখানে দ্বিপাক্ষিক ট্রানজিটের আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে আগরতলায় পণ্য পাঠাতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১০দিন এবং খরচ পড়বে সব মিলিয়ে ৩৫ মার্কিন ডলারের কম। বাংলাদেশের নৌবন্দর, আভ্যন্তরণীণ কন্টেইনার টার্মিনাল, ৫২ কিলোমিটারের বেশী সড়ক ব্যবহার করা হলেও এ খাত থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট ফি বাবদ বাংলাদেশ পাবে টনপ্রতি মাত্র ১৯২.২২ টাকা। ন্যূনতম এই ট্রানজিট ফি নির্ধারণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে পণ্য পরিবহন শুরুর অনেক আগে থেকেই ভারত বিনাশুল্কে ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করে আসছে। পরীক্ষামূলক ট্রান্সশিপমেন্টের নামে মূলত ২০১১ সাল থেকেই ভারত বাংলাদেশের বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবহার করে বিনাশুল্কে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে পণ্য পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। পালটানা বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনসহ  আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য পরিবহন করলেও এ থেকে বাংলাদেশ এক টাকাও পায়নি।
দেশের সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো ও বন্দরের বেহালদশাকে আমদানী-রফতানী, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অন্যতম বাধা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সেখানে ভারতীয় পণ্য পরিবহন ও ট্রান্সশিপমেন্টের নামে আমাদের বন্দর, কন্টেইনার টার্মিনাল এবং সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। আমাদের বন্দর, সড়কপথসহ অবকাঠামোর উপর ট্রানজিটের যে বাড়তি চাপ তৈরী হবে সে তুলনায় ট্রানজিট ফি খুবই অপ্রতুল। ট্রানজিটের ফলে রাস্তার উপর বাড়তি ধকল, যানজট ও পণ্যজটসহ অবকাঠামোগত ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় না নিয়েই ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে যথোপযুক্ত ট্রান্সশিপমেন্ট ফি নির্ধারণের লক্ষ্যে ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে কোর কমিটি গঠিত হয়েছিল সার্বিক বিষয়াবলী বিবেচনায় রেখে সে কমিটি টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা ফি নির্ধারণের সুপারিশ করলেও তা’ মাত্র ১৯২ টাকায় নামিয়ে আনার পেছনে কি যুক্তি রয়েছে তা’ বোধগম্য নয়। এমনিতেই বাংলাদেশকে ভারতের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের রুট হিসেবে ব্যবহারের মধ্যে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি ছাড়াও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ঝুঁকিও বিদ্যমান রয়েছে। সেখানে পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের নামে প্রায় ৫ বছর ধরে বিনাশুল্কে হাজার হাজার টন পণ্য পরিবহনের পর এখন নামমাত্র শুল্কে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কারণ জনগণ জানতে চায়। যেখানে ভারতের পক্ষে অতিরিক্ত হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ার ধকল, তিরিশ দিনের পথ ১০ দিনে এবং কমপক্ষে ১০০ ডলার বা ৮ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, সেখানে মাত্র টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা ফি নির্ধারণ ছিল বাংলাদেশের পক্ষে ন্যূনতম যৌক্তিক দাবী।
ঈদ সামনে রেখে বাংলাদেশের বাজারগুলো ভারতীয় পণ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। পাশাপাশি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঈদের বাজার করতে ভারতে যাওয়া সহজ করতে ৬০ হাজার ভিসা দেয়ার কথাও ইতিমধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বাজার এবং শিল্পখাতকে ধ্বংস করতে ভারতের পক্ষ থেকে সব রকম কারসাজি অব্যাহত আছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেই  ঈদের আগে ভারতের জন্য বহুমুখী ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করে দিল সরকার। ভারতীয় একপেশে নীতির কারণে দেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ বিলীন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের অনুকূলে শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে। ভারতীয় পণ্য এবং মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রবেশের কারণে বাংলাদেশের শিল্প এবং যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশী গরু ব্যবসায়ীরা উচ্চমূল্যে ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে। আমাদের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি সীমান্তে চোরাচালান ও সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারলেও দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালাতেও দ্বিধা করছেনা। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ঈদ সামনে রেখে বৈধ পথে ভারত থেকে পণ্য আমদানী কমে গেলেও অবৈধ পথে ভারতীয় পণ্যের চালান বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে দেশীয় শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উপরন্তু নামমাত্র মাশুলে ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থের ইস্যু। কেন কিভাবে টনপ্রতি ১৯২ টাকা ভারতীয় ট্রানজিট ফি নির্ধারিত হল জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনে তা’ আলোচিত ও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হোক। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, করিডোর বা একতরফা বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত করার সিদ্ধান্ত জনগণ মেনে নেবেনা। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই ট্রানজিট ফি ন্যূনতম ১ হাজার টাকা নির্ধারণের পদক্ষেপ নিতে হবে।    

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন