ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযানে গ্রেফতারকৃত খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীমের সহযোগীদের গ্রেফতারে মাঠে নেমেছে র্যাবের একাধিক দল। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো ও টেন্ডারসহ নানা অপকর্মের সহযোগীদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। রাজনৈতিক দলের নেতার বাইরে খালেদ ও জি কে শামীমের অপকর্মের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজদের তালিকা চ‚ড়ান্ত করা হলেও গতকাল পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
খালেদের উপস্থিতিতে হবে গ্রেফতার ও রিমান্ড শুনানি
ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের আলোচিত সাংগঠনিক সম্পাদক (পরবর্তীতে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার উপস্থিতিতে গ্রেফতার ও রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। মতিঝিল থানায় দায়ের করা মাদক মামলায় রোববার খালেদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার ও রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গুলশান থানায় দায়ের করা মাদক ও অস্ত্র মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে থাকায় এদিন তাকে আদালতে উপস্থিত করা যায়নি। রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরী এ আদেশ দেন। আদালতে মতিঝিল থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা বলেন, রোববার মতিঝিল থানায় করা মাদক মামলায় তার গ্রেফতার ও সাত দিনের রিমান্ড শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু গুলশান থানার মাদক ও অস্ত্র মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে থাকায় আদালতে খালেদকে উপস্থিত করা হয়নি। এ জন্য বিচারক তার উপস্থিতিতে গ্রেফতার ও রিমান্ড শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। অর্থাৎ যেদিন খালেদকে আদালতে উপস্থিত করা হবে সেদিনই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। গত ২০ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থানায় দায়ের করা মাদক মামলায় খালেদের বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সফিকুল ইসলাম আকন্দ।
মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম আকন্দ আবেদনে উল্লেখ করেন, মামলার এজাহারনামীয় পলাতক আসামি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশান থানার অস্ত্র মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তাকে মতিঝিল থানার ৩১ (৯) ১৯ মামলায় সাত দিনের রিমান্ড আবেদনপূর্বক জানাইতেছি যে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় র্যাবের বিশেষ অভিযানে তার গুলশান বাসা তল্লাশি করে অস্ত্র, মাদক ও বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় তিনি জানান যে, মতিঝিলের ইস্টার্ন কমলাপুর কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের পঞ্চম তলার ৪০২ নম্বর রুমে ভূঁইয়া গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে ব্যবসার আড়ালে মাদক ক্রয়-বিক্রয় ও সেবন করা হতো। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাক্ষীদের সম্মুখে তার অফিসের বিভিন্ন কক্ষ তল্লাশি চালান। তল্লাশিকালে তার অফিস থেকে ১৯০ পিস হালকা গোলাপি রঙের ইয়াবা, দেশি ও বিদেশি বিয়ার, সিসা ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
মামলার প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় যে, আসামির দখলে আরো বিপুল পরিমাণ সিসা, বিদেশি বিয়ার ও ইয়াবা ট্যাবলেট মজুত আছ। তাকে পুলিশ হেফাজতে এনে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরো বিপুল পরিমাণ সিসা, বিদেশি বিয়ার ও ইয়াবা ট্যাবলেট এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহসহ গ্রেফতার এবং উদ্ধারকৃত মাদকের উৎস সম্পর্কে তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এমতাবস্থায় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গুলশান থানার অস্ত্র আইনের মামলা হতে মতিঝিল থানায় করা মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের পুলিশ রিমান্ড একান্ত প্রয়োজন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সাত দিনের রিমান্ড শেষে ‘ক্যাসিনো’ খালেদকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে র্যাব। রিমান্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। এছাড়া গুলশান থানার অস্ত্র ও মাদক মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আরো ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-৩ এর এএসপি বেলায়েত হোসেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম দিদারুল আলম অস্ত্র মামলায় ৫ দিন ও মাদক মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ১৯ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় করা অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয় যুবলীগ নেতা খালেদ হোসেন ভূঁইয়াকে। এর মধ্যে অস্ত্র মামলায় চার দিন এবং মাদক মামলায় তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান-২ এর নিজ বাসা থেকে খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়।
সম্রাটকে আটকের ব্যাপারে ধূম্রজাল
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গ্রেফতার হয়েছেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে গত শনিবার বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, সম্রাট গ্রেফতার কি-না, এ বিষয় আপনারা দ্রুত জানতে পারবেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে। একটি সংস্থার এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সম্রাট গ্রেফতারের বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো সবুজ সঙ্কেত নেই। সম্রাট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যেই রয়েছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যে নির্দেশনা আসবে সে অনুযায়ী কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সংস্থার এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সম্রাট ও খালেদের সুবিধাভোগীদের তালিকায় শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সংগঠনের সুবিধাভোগী, পুলিশ ও সাংবাদিক রয়েছেন। এ কারণে তাকে গ্রেফতারের আগে অনেক বিষয় নিয়ে আরো স্বচ্চ তদন্ত করা প্রয়োজন। তবে সম্রাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পুরো অভিযানই প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
৬ দিনেও অধরা দুই আ.লীগ নেতা
ক্যাসিনো–কান্ডে জড়িত পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক, রূপন ভূঁইয়াসহ চারজনকে ৬ দিনেও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাদের ধরতে অভিযান চালানোর কথা বলে আসছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ইফতেখার আহমেদ বলেন, গেন্ডারিয়া থানায় মানিলন্ডারিং আইনে করা দু’টি মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আর ওয়ারী থানায় করা অস্ত্র মামলাটির তদন্ত করছে ওই থানার পুলিশ। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে সূত্রাপুর থানার বানিয়ানগরে এনামুল, তার ভাই রূপনের বাড়িসহ চারটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, ৪ কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার ও ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব। টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারে দুই ভাইয়ের সিন্দুক ভরা ছিল। এ ছাড়া তারা গেন্ডারিয়া ও ওয়ারীতে আরো দুই ব্যক্তির বাসায় টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার রাখতেন। ওই দু’জনের একজন রূপনের বন্ধু মো. হারুন অর রশিদ। তার বাসা গেন্ডারিয়ায়। অন্যজন তাদের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদ, তার বাসা ওয়ারীতে। র্যাব ওই দুই বাসা থেকেও টাকা ও অস্ত্র উদ্ধার করে। এসব ঘটনায় র্যাব চারজনের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় মানিলন্ডারিং ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দু’টি করে চারটি মামলা করে। এ ছাড়া ওয়ারী থানায় একটি অস্ত্র আইনে এবং গেন্ডারিয়া থানায় মানিলন্ডারিং আইনে দু’টি মামলা করা হয়। এনামুল গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও তার ছোট ভাই রূপন ভূঁইয়া একই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তারা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ একাধিক ক্লাবের ক্যাসিনো চালাতেন বলে র্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন