জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম সম্মেলন শেষ হয়েছে। সেখানে বিশ্বনেতারা নিজ নিজ দেশের পক্ষে বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। বিশ্বনেতারা মূলত এই অধিবেশনের জন্যই প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে নিজ দেশ ও সরকারের অবস্থান বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। জাতিসংঘের চুয়াত্তরতম সম্মেলনে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ একটি সাবর্জনীন ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে। সেই সাথে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের নেতাদের উপর। বিশেষত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরণ, অনির্দ্দিষ্টকালের কার্ফিউসহ ভারত সরকারের অগণতান্ত্রিক নিবর্তনমূলক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে পারমানবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জাতিসংঘে একটি ক’টনৈতিক মল্লযুদ্ধের আশংকা করা হচ্ছিল। গত ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ এবং কার্ফিউ জারি করে ৮০ লাখ কাশ্মীরিকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখার মধ্যে সেখানে জম্মু কাশ্মীর ও আজাদ কাশ্মীর এক চরম বিষ্ফোরণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীরা নিজ নিজ দেশের অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার মধ্যে জাতিসংঘের ৭৪তম সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে তাদের মধ্যে সাইডলাইন বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়েও জল্পনা ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়েও ডিপ্লোম্যাটিক ব্লেইম গেম দেখা গেছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিরোধ নিরসনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আলোচনার প্রস্তাব অবারিত রেখেছেন। কাশ্মীর ইস্যুতে কোন মধ্যস্থতা ছাড়াই দুই নেতার মধ্যে বিশ্ব ফোরামের সাইড লাইনে আলোচনার যে সুযোগ ছিল তা মূলত নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের একগুয়েমির কারণে সম্ভব হয়নি। কাশ্মীরসহ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনার প্রেক্ষাপট এবং সামগ্রিক অবস্থা বর্ণনাসহ সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি তুলে ধরে ২৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দেয়া দীর্ঘ ৫০ মিনিটের বক্তব্য সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘে দেয়া একজন নেতার মাইল ফলক বক্তৃতা হিসেবে গণ্য হতে পারে। অত্যন্ত ধীর স্থির ও প্রাঞ্জল ইংরেজিতে বক্তৃতা দেয়ার সময় ইমরান খানকে অত্যন্ত সপ্রতিভ, দৃঢ়চেতা এবং সূ²দর্শি বলে প্রতিয়মান হয়েছে। ইসলামোফোবিয়া ও সন্ত্রাসবাদের জটিল সমীকরণকে তিনি বিশ্বনেতাদের সামনে পডিয়ামে দাঁড়িয়ে একজন সুদক্ষ বাগ্মী অধ্যাপকের মত ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এসব বিষয় নিয়ে এভাবে কেউ আর কখনো বলেনি। গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ক্লাইমেট চেঞ্জে পাকিস্থানের সম্ভাব্য বিপদ, হিমালয়ের গেøসিয়ার দ্রুত গলে যাওয়া এবং গঙ্গা ও সিন্ধু নদীর প্রবাহ ভারত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করার বিষয়টিও যথার্থভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ইমরান খান তার বক্তব্য শুরু করেছেন। এরপর উন্নয়নশীল দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার, ধর্মের র্যাডিকেলিজম, ইসলামোফোবিয়া, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং পাকিস্তান ও মুসলিম বিশ্বের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন তা সত্যিই সব মুসলমান ও শান্তিকামী মানুষের জন্য অত্যন্ত উদ্দীপনামূলক ছিল। তবে ইমরান খান স্পষ্টভাষায় বলেছেন জাতিসংঘের এই অধিবেশনে তার যোগদানের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে কাশ্মীরের প্রসঙ্গ বিশ্বের সামনে তুলে ধরা এবং কাশ্মীরিদের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা। তিনি যর্থাথ যৌক্তিক গুরুত্ব ও জোরালো বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার অবস্থান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এত সীমিত পরিসরে, অল্প কথায় ওয়ার অন টেররিজম, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ, বর্ণবাদী সন্ত্রাস, উগ্র জাতীয়তাবাদের স্বরূপ তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইমরান খানের পারঙ্গমতা অনেককই বিষ্মিত করেছে। বিদ্যমান বিশ্ববাস্তবতায় অমিমাংসিত কয়েকটি ইস্যুতে জাতিসংঘ, বিশ্বনেতা এবং মুসলমান নেতাদের নিরবতা ও আপসকামিতার সমালোচনা তিনি একই সঙ্গে বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমান এবং শান্তিকামি বিশ্বের মুখপত্রের ভ’মিকা পালন করেছেন।
আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করেছিলাম, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীর প্রসঙ্গসহ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ে কথা বলবেন। হিন্দিতে দেয়া ১৭ মিনিটের বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই ছিল তার দেশে তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড, কোটি কোটি টয়লেট নির্মান এবং ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনার ইঙ্গিত। তিনি ৩০ হাজার বছর আগে লেখা তামিল কবির উদ্ধৃতি দিলেও কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবরোধ, নিপীড়ন, হাজার হাজার কাশ্মীরি যুবকের ফোর্স ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স এবং কাশ্মীরে যথেচ্ছ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কাশ্মীরিদের ভবিষ্যত নিয়ে সারাবিশ্বে কোটি কোটি মানুষের উদ্বেগ সম্পর্কে তাঁর নিরবতা ছিল বিষ্ময়কর। সারাবিশ্ব যখন এ প্রসঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব হয়ে বসেছিল, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মুখস্ত কিছু কেতাবি বক্তব্য দিয়ে বিশ্বকে শান্তির বানী শোনালেন যা বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অপপ্রয়াস হিসেবেই গণ্য হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের আরএসএস এবং নরেন্দ্র মোদির উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের পরিকল্পনা এবং জাতিগত নিমূর্লের এজেন্ডা তুলে ধরেছেন। সেখানে মোদি কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, ফিলিস্তিন, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনাসহ সমাকালীন বিশ্বের প্রধান ইস্যুগুলো নিয়ে বক্তব্য দিতে ব্যর্থতা শুধু মোদির নেতৃত্বের যোগ্যতাকেই হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, সেই সাথে বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে যর্থাথ ভ’মিকা পালনে ভারত রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে। অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। কাশ্মীর ইস্যুতে ইতিমধ্যে ভারত ও পাকিস্তান অন্তত তিনবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এসব যুদ্ধে দুই পক্ষের অনেক সৈন্য এবং সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছেন। ভারতীয় সেনাদের হাতে হাজার হাজার কাশ্মীরির মৃত্যু এবং অনবরত রক্ষক্ষরণের পরও কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম একদিনের জন্যও থামেনি। এখন ৮০ লাখ কাশ্মীরিকে দাবিয়ে রাখতে সেখানে ৯ লাখ ভারতীয় সেনার পাহারা বসিয়ে কার্যত কাশ্মীরিদের খাঁচাবন্দি করে রাখা হয়েছে। যখনই কার্ফিউ প্রত্যাহার করা হবে তখনি সেখানে গণবিষ্ফোরণ ঘটবে। কোনো স্বাধীনতাকামী জাতি, যারা আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করতে রাজি নয়, এমন জাতিকে সামরিক শক্তি দিয়ে দাবিয়ে রাখা অসম্ভব। ইমরান খানের জাতিসংঘ ভাষণে এ বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এবং তথাকথিত ইসলামিক র্যাডিক্যালাইজেশন বা ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের জন্য পশ্চিমা নেতাদের ভ্রান্ত নীতি এবং লেবেলিং এবং প্রোপাগান্ডাকে দায়ী করেছেন। আমেরিকায় নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও মিডিয়াগুলো যখন র্যাডিকেল ইসলামের নাম দিয়ে তথাকথিত মুসলিম সন্ত্রাসবাদের উপর দোষ চাপিয়ে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছিল, তখন মুসলমান নেতারা এর প্রতিবাদ বা প্রকৃত বিষয়গুলো তুলে ধরার বদলে তারা মডারেট মুসলিম হওয়ার ভণিতা করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সূচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ অনেক বড় ভুল ছিল বলে স্বীকার করেন ইমরান খান।
একই রাজনৈতিক গ্রুপ কিভাবে কাল ও প্রেক্ষাপট ভেদে পরাশক্তিগুলোর কাছে মুক্তি সংগ্রামী এবং সন্ত্রাসী আখ্যায়িত হয় তার চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন ইমরান খান। ভাসুরের নাম কেউ মুখে আনতে চায়না। ইমরান খান সে রাখঢাক রাখেননি। সোভিয়েত আমলে আফগানিস্তানে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তালেবানদের যুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা তাদেরকে মুজাহিদ বা মুক্তি সংগ্রামী আখ্যায়িত করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে তাদেরকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। সে সময় সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো তালেবানদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করত। তবে সে সন্ত্রাসী মুজাহিদদের পেছনে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আলকায়েদা গঠনেও মার্কিন সামরিক বাহিনীর ভ’মিকা এখন আর অজ্ঞাত নয়। সোভিয়েত সৈন্যদের হটিয়ে আফগানিস্তান দখলদার মুক্ত হওয়ার মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে পরিবেশ পরিস্থিতি বদলে গেলে তাদের হাতে প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠা তালেবানরা মার্কিনীদের কাছে সন্ত্রাসী হয়ে গেল। গত দেড় দশক ধরে লড়াই করেও মার্কিন বাহিনী তালেবানদের কাবু করতে পারেনি। এখন তারা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে। এ ক্ষেত্রে তালেবানদের সাথে আলোচনা ও সমঝোতা ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় মার্কিনীদের সাথে আফগান তালেবানদের শান্তি আলোচনা চলার মাঝখানে গত আগস্ট মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ শান্তি আলোচনা ভন্ডুল করে দেয়ার দু’দিন পরেই তালেবান প্রতিনিধিদের মস্কোতে ডেকে নিয়ে রাশিয়ান প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর পাশাপাশি সময়েই তালিবান নেতাদের নিয়ে চীনেও বৈঠক হয়। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, মার্কিনীদের হঠাতে রাশিয়া ও চীন তালেবানদের পাশেই আছে। বিশ্বশক্তিগুলো মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার চেয়ে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং কৌশলগত লাভালাভের লক্ষ্যকেই বেশি মূল্য দেয়। এখানে শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের বানী মূল্যহীন। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ধর্মীয় র্যাডিকেলাইজেশন, উগ্র জাতীয়তাবাদের হুমকি ও পশ্চিমাদের পুঁজিবাদি দৃষ্টিভঙ্গির স¦রূপ উন্মোচন করেই ক্ষান্ত হননি, সেই সাথে পশ্চিমাদের এহেন ভ’মিকার পেছনে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। কাশ্মীরিদের আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘে ১১বার রেজুলেশন পাস হওয়ার পরও পশ্চিমারা কাশ্মীরিদের জন্য কিছুই করেনি। এর কারণ হচ্ছে, তারা ভারতকে ১৩০ কোটি মানুষের বিশাল বাজার হিসেবে দেখে। এখানে তারা বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রশ্নে কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। অতএব জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলমানরা পশ্চিমাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ও ভ’-রাজনৈতিক কৌশলের শিকার হয়। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের নিস্পৃহ থাকার সুযোগ নাই। তিনি সম্ভাব্য সব উপায় ও ঝুঁকি সামনে রেখে কাশ্মীর প্রশ্নে শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত একটি পারমানবিক যুদ্ধে রূপ নিলে সারাবিশ্বকেই তার মাশুল গুনতে হবে, এটাও বলছেন ইমরান খান। মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে জাতিসংঘ এবং মুসলিমবিশ্বের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে ইমরান খান প্রশ্ন তুলেছেন, কাশ্মীরের পাশাপাশি তিনি এক লাইনে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও কথা বলেছেন। তবে তিনি বা অন্য কোনো মুসলিম নেতা চীনের জিনজিয়ানে উইঘুর মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। ভারতের বিশাল বাজার ধরে রাখতে কাশ্মীর প্রশ্নে পশ্চিমারা গত ৭৪ বছরেও কোনো কার্যকর ভ’মিকা পালন করেনি। একইভাবে চীনের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে এবং কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় ইমরান খানসহ কোনো মুসলিম নেতাই উইঘর মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে কথা বলছেন না। চীনের স্বার্থের বাইরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে ইমরান খানের বক্তব্য প্রশংসার দাবী রাখে।
কাশ্মীরে ভারতের নিবর্তনমূলক ভ’মিকায় বাংলাদেশের ৯০ভাগ মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃষ্টি দিলে এই সত্য প্রমানীত হবে। রক্ত দিয়ে স্বাধীন করা বাংলাদেশের নাগরিকরা একইভাবে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের প্রতি সংহতি অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নেও বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরঙ্কুশ সমর্থন অটুট রয়েছে। যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একাত্তুরে আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম, সেই একই বাস্তবতার মুখোমুখি প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে এদেশের মানুষের সমর্থন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ। আমাদের সংবিধানেও সে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু বড় প্রতিবেশির সাথে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে আমাদের সরকার জনগনের মনোভাবের কথা অগ্রাহ্য করেই কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত সরকারের প্রতি নি:শর্ত সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। যদিও ভারতের অনেক রাজনৈতিক দলও মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতির বিরোধিতা করছে। কাশ্মীর প্রশ্নে বাংলাদেশ নিরবতা বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে পারত। কোনো পক্ষাবলম্বন না করেও কাশ্মীরে যেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়, এমন দাবী করাই ছিল ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কৌশলগত অবস্থান। অথচ মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের হাতে গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার অথবা ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রিফিউজির ভারে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের সংকটে মোদি সরকার মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের প্রতি প্রকাশ্য ও নিরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের আহ্বানে গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের(ইউএনএইচসিআর) এক ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলের ৪৭টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রস্তাবের পক্ষে ৩৭টি দেশ ভোট দেয়। সদস্য না হওয়ায় মিয়ানমার ভোট দিতে না পারলেও চীন এবং ফিলিপাইন কাউন্সিলের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ভারত, নেপাল, জাপান, অ্যাঙ্গোলা, ক্যামেরুন ও কঙ্গোসহ ৮টি দেশ। রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ স্বার্থ রয়েছে। এ কারনে সেখানে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যাকারীদেরও রক্ষা করতে চাইছে চীনারা। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ভারতেও আছে। অতএব কমবেশি তারাই এর ভুক্তভোগী। শতকোটি মানুষের আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত কেন এমন একটি ইস্যুতে পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে তা ভাববার বিষয়। ভারতের এমন ভ’মিকাকে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী নীতিগত অবস্থান বলে মনে করলে কি খুব ভুল হবে? উভয় দেশের দায়িত্বশীলদের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতায় সমাসীন ভারত কেন রোহিঙ্গা সংকটের মত একটি আঞ্চলিক সমস্যায় লুকোচুরি খেলছে তা বুঝতে না পারলে বাংলাদেশকে আরো বহুদিন ভুগতে হবে। ইমরান খান তাঁর ভাষণে বিজেপি ও আরএসএস’র সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী ও উগ্রজাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বর্ননা দিয়েছেন। জাতিসংঘ ৭৪তম অধিবেশনের ভাষনে ইমরান খান চারটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন, এর মধ্যে কাশ্মীর ইস্যুকে তার মূল ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছেন। বাকি তিনটি ইস্যু হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন, দরিদ্র দেশ থেকে ধনী রাষ্ট্রে অর্থ পাচার এবং ইসলামোফোবিয়া। এই তিনটি ইস্যুই বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মুসলমান ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতি, দারিদ্র নিরসন এবং শান্তি-স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রকিবন্ধকতা। জাতিগত সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ, অভিবাসন সংকট ইত্যাদি যে সব সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা হচ্ছে, এসব সমস্যার মূল উৎস হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমাদের ভ্রান্ত ধারণা, টাকা পাচারের অবাধ সুযোগ এবং মানবাধিকার ও শান্তির চাইতে বাণিজ্যিক স্বার্থ ও পুজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সংকটের বাইরে ইমরান খানের প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সাহসী বক্তব্য বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে এক নতুন আশার আলো দেখাবে। তবে জাতিসংঘের ভ’মিকা ও সামর্থে কেউই আশাবাদী হতে পারছেন না। কাশ্মীরিরা ভারতীয় বাহিনীর, ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলের, আফগানরা আমেরিকার, উইঘুরিরা চীনের এবং রোহিঙ্গারা মিয়ানমার বাহিনীর হাতে জাতিগত নির্মূলের সম্মুখীন। এরা সবাই মুসলমান, আবার তাদেরকেই টেরোরিস্ট তকমা এঁটে দিচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়া এবং আঞ্চলিক বশংবদ শাসকরা। এহেন বাস্তবতায় টিকে থাকার জন্য মুসলমানরা কি আত্মসমর্পণ করবে, নাকি লড়াই করবে? কাশ্মীরের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে শেষ পর্যন্ত লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। শান্তিকামী বিশ্ব সব সময় মজলুমের পক্ষেই থাকে। শুধু মারণাস্ত্র দিয়ে সব যুদ্ধে জয় লাভ করা যায় না। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এ সত্যের বলেই, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর ও রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন