অবৈধ ক্যাসিনো ও টেন্ডারবিরোধী অভিযানের ১৪ দিন পেরিয়ে গেলেও নেপথ্যের মদদদাতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতদিনেও রাঘববোয়ালদের ধরতে না পারায় অভিযানের কার্যকরিতা নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে। নেপথ্যে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করতে না পারলে চলমান দুর্নীতিবিরোধি অভিযানের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের।
অন্যদিকে রিমান্ডে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম-খালেদ মাহমুদ টেন্ডার-ক্যাসিনোর টাকার কমিশন কারা পেতেন-সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে। দু’জনের তথ্যে প্রশাসনের বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের নাম প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ অনেককেই এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। ক্যাসিনোসহ দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর অনেকে এরই মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এমনকি সম্রাটের অবস্থান নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে আটক করা হয়েছে কিনা তা খুব শীঘ্রই জানা যাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের চারদিন পেরিয়ে গেলেও সম্রাটের বিষয়ে ধুম্রজাল এখনও কাটেনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, গ্র্রেফতার করার মতো তথ্য-প্রমাণ হাতে পেলে দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ নানা অপরাধের অভিযোগ ওঠা নেতাদের গ্রেফতার করা হবে। সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা এ সময় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কাছে জানতে চান ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে শুদ্ধি অভিযানে ছাড় দেওয়া হচ্ছে কিনা। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, কোনো অপরাধীই ছাড় পাবেন না। তথ্য-প্রমাণ পেলেই গ্রেফতার করা হবে।
একটি সংস্থার দায়িত্বশীল দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গ্রেফতার হয়ে যারা রিমান্ডে আছেন, তারা জিজ্ঞাসাবাদে যেসব প্রভাবশালী-প্রশাসনের ব্যক্তিদের নাম বলেছেন, তাদের যত দ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় আনা জরুরি। যতই কালক্ষেপণ হবে, ততই কঠিন হবে মূলহোতাদের আটক করা। কারণ এ সময়ের মধ্যে তারা বিদেশেও পাড়ি জমাতে পারেন।
সূত্র জানায়, বছরের পর বছর আইন-শৃংখলা বাহিনীর নাকের ডগায় ক্যাসিনো বা জুয়া চললেও এতদিনে বড় ধরনের কোনো অভিযানে নামেনি কেউ। এতে ক্যাসিনোয় জড়িত আলোচিত ব্যক্তিদের নামও ছিল অপ্রকাশ্য। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদ্য বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতারের পর ক্যাসিনোয় জড়িত আলোচিতদের নাম উঠে আসে। ক্যাসিনো বা জুয়া থেকে কারা, কীভাবে, কী পরিমাণ টাকা নিয়েছে সে বিষয়টিও উঠে আসে। খালেদ মাহমুদ গ্রেফতারের পর ক্যাসিনো-সংক্রান্ত ঘটনায় আলোচিতদের অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। তবে আইন-শৃংখলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জড়িতরা তাদের নজরদারিতে রয়েছেন। তার বিদেশ যাত্রা ঠেকাতে বিমানবন্দর ও সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়।
র্যাবের কাছ থেকে পাওয়া এক তালিকা থেকে জানা যায়, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাসিনোর মূল নিয়ন্ত্রক ইসমাইল হোসেন সম্রাট। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনোর মূল নিয়ন্ত্রক স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউছার।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদ এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গেছেন। এছাড়া ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউছার, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোবাশ্বের চৌধুরী, কাউন্সিলর কাজী আনিসুর রহমান, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু, তার ভাই রুপন ভূঁইয়া ও আবদুর রশীদের নাম এলেও তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্রাটের অন্যতম সহযোগী যুবলীগ নেতা আরমানুল হক আরমান, বাদল এবং জুয়াড়ি খোরশেদ আলমও গা-ঢাকা দিয়েছেন। এছাড়া মতিঝিলের দিলকুশা ক্লাবের আবদুল মান্নান, আজাদ বয়েজ ক্লাবের একেএম নাছির উদ্দিন ও হাসান উদ্দিন জামানের ‘ক্যাসিনোর ব্যবসা’র সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলেও এখনও তাদের গ্রেফতার করা যায়নি।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা তাদেরকে (জি কে শামীম-খালেদ মাহমুদ) নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। অনেক বিষয় নিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মদদদাতা ও সহযোগি হিসেবে যাদের নাম প্রকাশ করেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। এছাড়া যে সব তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে সেগুলো আমরা আমলে নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করছি।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, জুয়া ক্যাসিনো টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই। নিঃসন্দেহে আশা করব এই অভিযান চলমান থাকবে এবং রাঘববোয়ালরা ধরা পড়বে। সেটা না হলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এবং অভিযানের উৎস প্রশ্নবিদ্ধ হবে
বিশ্লেষকদের আরও অভিমত জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত থাকলেও তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। অপরাধের গভীরে গিয়ে এর মূল উৎপাটন করতে হবে। যতই কালক্ষেপণ হবে, ততই কঠিন হবে মূলহোতাদের আটক করা। কারণ এ সময়ের মধ্যে তারা বিদেশেও পাড়ি জমাতে পারেন। শুধু তাই নয়, তাদের হাতে থাকা অবৈধ টাকা খরচ করে নিজেদের আড়াল করতে পারে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে চলছে সারাদেশে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। গত ১৪দিনে মোট ৩৪টি অভিযান (র্যাব ১৮ ও পুলিশ ১৪) পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর যুবলীগের দুই নেতা- খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীম ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজসহ ১৫জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এসব অভিযানে নগদ ১৭ কোটি টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) এবং ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ২০১ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেয়া হয়েছে।
মানি লন্ডারিং মামলায় শামীমকে ১০ দিনের রিমান্ডে চায় সিআইডি
গুলশান থানায় দায়ের করা মানি লন্ডারিং মামলায় যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীমের (জি কে শামীম) ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে রিমান্ডের আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু সাঈদ। আদালত রিমান্ড আবেদনের শুনানির জন্য বুধবার দিন ধার্য করেছেন। আদালতের গুলশান থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) পুলিশের উপ-পরিদর্শক শেখ রবিকুল রহমান বলেন, গুলশান থানায় মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলায় জি কে শামীমের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। শামীম বর্তমানে অন্য মামলায় রিমান্ডে রয়েছেন। বুধবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে। এরপরই তাকে গ্রেফতার ও রিমান্ড বিষয়ে শুনানি হবে।
এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর জি কে শামীমসহ তার সাত দেহরক্ষীকে গুলশান থানার মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদনে করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু সাঈদ। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারী তার সাত দেহরক্ষীকে মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেফতার দেখান। এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর অবৈধ অস্ত্র ও মাদক মামলায় জি কে শামীমের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর মধ্যে অস্ত্র মামলায় ৫দিন ও মাদক মামলায় ৫দিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন