ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ১৬ দিনেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন অনেক ক্যাসিনো গডফাদার। বিশেষ করে ক্যাসিনো কান্ডে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তি এবং তার ঘনিষ্ঠদের এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও দীর্ঘদিন ধরে তারাই রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে কোটি কোটি টাকার বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।
যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন না দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তার অবস্থান নিয়ে ধূম্রজাল থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো-টেন্ডারবাজির সাথে জড়িত ও মদদদাতা এবং সুবিধাভোগীদের নাম প্রকাশ হলেও জড়িতরা ধরা পড়ছে না। ১৮ অক্টোবর অভিযান শুরুর পর কেটে গেছে ১৬ দিন। এই সময়ে ক্যাসিনো সম্রাটের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৫ দিনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিলের একাধিক ক্লাবে পশ্চিমা ধাঁচের উন্নত জুয়ার আসরে ‘ক্যাসিনোবিরোধী’ অভিযান শুরু করে এলিট ফোর্স র্যাব। র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো মেলার পাশাপাশি সেগুলো পরিচালনায় যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়। ওইদিনই গ্রেফতার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, পরদিন কলাবাগান ক্লাব থেকে গ্রেফতার হন কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ। দুই দিন পর গ্রেফতার হন ঠিকাদার জি এম শামীম, যিনিও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। এরপর একে একে থানা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। উদ্ধার করা হয় অবৈধ অস্ত্র, লাখ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার।
অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নাম আলোচিত হওয়ায় তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয় ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী এবং ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার স্ত্রীর। এছাড়া গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদের নিজস্ব এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জব্দ করা হয়। কে, কখন ধরা খান এমন আতঙ্কে রয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজি কাজে অভিযুক্ত অনেক প্রভাবশালীও।
জিজ্ঞাসাবাদে অনেকের নাম বলেছেন খালেদ-জি কে শামীম
ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীম জিজ্ঞাসাবাদে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার নাম বলেছেন। একই সঙ্গে কোন ক্যাসিনো থেকে কত টাকা পেতেন এবং চাঁদাবাজির অর্থের পরিমাণও জানিয়েছেন তারা। দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়ে র্যাব তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
র্যাব-৩ উপপরিচালক ফাইজুল ইসলাম বলেন, রিমান্ড চলছে। জি কে শামীম ও খালেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। রিমান্ড শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।
র্যাব সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় খালেদ জানান, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়েও কাজ করেন তিনি। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতেন সব সময়। ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন। এসব অর্থ যুবলীগের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের অনেক সিনিয়র নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ভাগ দিতেন। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছেন তিনি। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার আরএইবি ব্যাংকে ৬৮ লাখ টাকা জমা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের ইউওবি ব্যাংকে দেড় কোটি টাকা, ব্যাংকক অব ব্যাংকে এক লাখ বার্থ, বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকে নিজের নামে ১৯ কোটি টাকার এফডিআর, ব্র্যাক ব্যাংকে স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের নামে ৫০ লাখ টাকা, এনসিসি ও ব্র্যাক ব্যাংকে অর্পণ প্রোপার্টিজের নামে ১৫ লাখ টাকা করে ৩০ লাখ টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা খালেদের ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠদের নাম জানিয়েছেন তিনি। এরমধ্যে ঢাকার ৪-৫জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রয়েছেন।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম অনেক তথ্য জানিয়েছেন। আবার অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন। সরকারি ভবনের নির্মাণকাজ পেতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, গণপূর্তের প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছেন যুবলীগের নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম। খালেদ ও শামীমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ও সহযোগীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মামলার তদন্ত তদারক করছেন র্যাবের এমন একজন কর্মকর্তা জানান, জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে তার অনৈতিক কর্মকান্ড এবং তার কাছ থেকে লাভবান হওয়া অনেকের নাম পাওয়া গেছে। যাচাই-বাছাই শেষে নামগুলো প্রওকাশ করা যাবে।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে শামীম বলেন, টেন্ডারবাজি ও সরকারি বড় বড় ভবনের কাজ পেতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, গণপূর্তের প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দেয়ার পাশাপাশি তাদের পাঁচ তারকা হোটেলে বিনোদনের ব্যবস্থা করতেন শামীম। কাজ পেতে তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন