শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইসলামোফোবিয়া নিয়ে জাতিসংঘে ইমরান খানের বক্তব্য

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় এক যুগান্তকারী বক্তব্য দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে দেয়া ৫০ মিনিটের এ ভাষণে চারটি বিষয়ের তৃতীয় এবং অন্যতম বিষয় হলো ‘ইসলামোফোবিয়া’ (ইসলামভীতি)। ভাষণটি ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে এবং আমার মনে হয়, সাম্প্রতিককালের মধ্যে কোনো মুসলিম নেতার আন্তর্জাতিক কোনো অধিবেশনে দেয়া জনপ্রিয় ভাষণ হিসেবে এটি বিবেচিত হয়েছে। তার দেয়া ভাষণে, ‘ইসলামোফোবিয়া’ সম্পর্কে আমার মতো অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট হবে বলে আমি মনে করি। ‘ইসলামোফোবিয়ার’ ধারণা প্রচলন করা বিশ্বনেতাদের সামনে তাদেরই ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়ার যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন ইমরান খান তা সত্যিই বিরল। পাঠকদের জন্যে সে ভাষণের এই অংশটুকু তুলে ধরা হলো:
বর্তমান বিশ্বে ১.৩ বিলিয়ন মুসলিমের বসবাস। লক্ষ লক্ষ মুসলিম বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করছে। ৯/১১ এর পর ইসলামোফোবিয়া (ইসলাম ভীতি) তৃণমূলে যেভাবে বেড়েছে তা সত্যিই বিপজ্জনক। মানব সম্প্রদায় একসাথে বসবাস করছে। তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া দরকার। কিন্তু ইসলামোফোবিয়া তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে।
মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরিধান করাও একটা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু দেশে এটি গুরুতর ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। হিজাবের প্রতি তাদের অভিব্যক্তি এমন, যেন এটা কোনো অস্ত্র। সেসব দেশে নারীরা পোশাক পরিত্যাগ করতে পারবে, কিন্তু হিজাব পরতে পারবে না। এসব কী (কেন) ঘটছে? ইসলামোফোবিয়ার কারণে এমনটা ঘটছে।
এটা কখন শুরু হয়েছে? ৯/১১ এর পর। কেন শুরু হয়েছে? কারণ, কিছু পশ্চিমা নেতা ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সম্পূরক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তারা ব্যবহার করেছে ‘ইসলামিক টেরোরিজম’ (ইসলামী সন্ত্রাসবাদ), ‘র‌্যাডিকাল ইসলাম’ (মৌলবাদী ইসলাম) পরিভাষাগুলো। র‌্যাডিকাল ইসলাম কী? ইসলাম তো কেবল একটাই। আর এ ইসলাম নবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসরণীয় ইসলাম। এ ছাড়া আর তো কোনো ইসলাম নেই। র‌্যাডিক্যাল ইসলাম, ইসলামিক টেরোরিজম (পরিভাষা) দ্বারা তারা প্রাচ্যের মানুষের কাছে কী মেসেজ দিতে চায়? সেখানে কেন এই ইসলামোফোবিয়া? যে ব্যক্তি নিউইয়র্কে কিংবা মধ্য আমেরিকা অথবা ইউরোপে বসবাস করছে সে কীভাবে ‘মডারেট মুসলিম’ এবং ‘রেডিক্যাল মুসলিমের’ মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করবে? কারণ, সন্ত্রাসের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এইসব (পরিভাষা) ‘ইসলামিক টেরোরিজম’, ‘ইসলামিক র‌্যাডিকালিজম’ দুঃখজনকভাবে নেতাদের দ্বারাই ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলামোফোবিয়ার এটি হলো মূল কারণ। এটাকে মুসলিমদের মাঝে বলা হয় ‘পেএন’। আর আমরা দেখছি, এই ইসলামভীতি (ইসলামোফোবিয়া) এক দেশ থেকে অন্যদেশে প্রবেশ করছে। আর এটি (পরিবেশ) নষ্ট করছে। আমি বলতে চাই, ইউরোপিয়ান দেশগুলো মুসলিম কমিউনিটিগুলোকে ‘মারজিনাইজিং’ করছে (অধিকার খর্ব করা বা বঞ্চিত করা)। আমরা জানি যে, ‘মারজনাইজেশন’ ‘রেডিক্যালাইজিং’ এর দিকে নিয়ে যায়। সিরিয়া কিংবা অন্যান্য জায়গায় যেসব মুসলিমকে আমরা মিলিট্যান্ট-এর ভ‚মিকায় দেখি তারা মূলত অধিকার বঞ্চিত মুসলিম সম্প্রদায়ের।
এখানে আমার পয়েন্ট হলো, আমাদের অবশ্যই এই ইস্যুটিকে স্পষ্ট করতে হবে। দুঃখিত, আমাকে বলতে হচ্ছে যে, আমরা মুসলিম নেতারা এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি না। শুধু মাত্র ৯/১১ এর পরে যখন রেডিক্যাল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল তখনও কেউ প্রাচ্যকে এটা জানায়নি যে, ইসলামে কোনো রেডিক্যালিজম নেই। প্রত্যেক মানুষ্য সম্প্রদায়ের মাঝে রেডিক্যাল (মৌলবাদী) কিছু মানুষ রয়েছে, কিছু মানুষ আছে যারা ‘লিবারেল’ (উদার) এবং মডারেট (সংস্কারবাদী)। সকল সম্প্রদায়ের মাঝে এমনকি খ্রিস্টান, ইহুদি সবার মাঝেই কিছু রেডিক্যাল মানুষ আছে। কিন্তু ইসলাম (ধর্ম) র‌্যাডিকাল নয়। তেমনি ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা হিন্দু ধর্ম এগুলোর কোনোটিই র‌্যাডিকাল নয়। কোনো ধর্মই র‌্যাডিকালিজম (মৌলবাদ) প্রচার করে না। সকল ধর্মের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ন্যায়পরায়ণতা যা মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে মুসলিম নেতারা র‌্যাডিকালিজম নিয়ে কথা বলতে ভয় পান, তারা মডারেট হতে চান। এমনকি পাকিস্তান সরকার একটি পরিভাষা ব্যবহার করে তা হলো ‘ইনলাইটেন মডারেশন’। কিন্তু কেউ এটির অর্থ জানে না। তারপরেও প্রত্যেকেই মডারেট হওয়ার জন্য পশ্চিমা স্যুট পরা শুরু করেছে। এমনকি যারা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না তারাও মডারেট হওয়ার জন্য ইংরেজিতে কথা বলেন। কারণ, আমরা এবং মুসলিম বিশ্বও প্রাচ্যের কাছে এটি ব্যাখ্যা পর্যন্ত করিনি যে, ‘রেডিক্যাল ইসলাম’ বলতে কিছু নেই।
এটির অন্যতম কারণ যে, ৯/১১ এর পরে ইসলামকে টেরোরিজমের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। কারণ এটি ছিল সুইসাইড অ্যাটাক (আত্মঘাতী হামলা)। ৯/১১ এর হামলাটি আত্মঘাতী হামলাই হয়েছিল। তখন এই সমীকরণও তৈরি হয়েছিল যে, মুসলিমরা আত্মঘাতী হামলা করে, কারণ তারা এসবের মধ্য দিয়ে পবিত্র হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। কেউ কেউ আবার নারীদের আত্মঘাতী হামলার বিষয়টিকেও নিয়ে এলো। এ পরিস্থিতিতে আমরা কেউ এ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা পর্যন্তও করিনি। কেউ এ বিষয়ে গবেষণা করেনি যে, ৯/১১ এর পূর্বে অধিকাংশ ‘সুইসাইড অ্যাটাক’ করেছিল তামিল টাইগাররা। তারা ছিল হিন্দু। কিন্তু কেউ হিন্দু ধর্মকে এর জন্য দোষারোপ করেনি। হিন্দু ধর্মের সাথে সুইসাইড অ্যাটাকের সমীকরণ মিলায়নি; এমনকি শ্রীলংকার ঘটনার পরেও।
আমরা জানি যে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে জাপানিজ কামিকিজ পাইলাটদের আত্মঘাতী হামলাকেও আমরা কোনো ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত করিনি। কিন্তু এখানে আমাদেরকে মডারেট হিসেবে প্রমাণ করার জন্যে চেষ্টা করছি তবুও প্রাচ্যের কাছে ব্যাখ্যা করছি না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এখানে আমি ইসলামোফোবিয়াকে ব্যাখ্যা করার জন্যে উল্লেখ করতে চাই, আমি এটাকে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, আমি পেশাগত খেলোয়াড় হওয়ার কারণে বেশ অনেকটা সময় ইংল্যান্ডে বসবাস করেছিলাম। সুতরাং আমি জানি, কীভাবে প্রাচ্যের মানুষের মানসিকতা কাজ করে এবং ধর্ম সম্পর্কে তাদের অনুভ‚তি কেমন। এভাবে ইসলাম সম্পর্কে তারা ভুল বুঝেছে এবং এটি ইসলামোফোবিয়ার অন্যতম কারণ।
১৯৮৯ একটি ‘মিলাইনিং, ইনসাল্টিং, রেডিকুলিং প্রফেট মুহাম্মদ’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে, মুসলিম বিশ্বে তার (বিরোধিতা করে) প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছিল। তখন, প্রাচ্যের লোকেরা বুঝতে পারেনি যে, কেন মুসলিমরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, এতে তাদের কী সমস্যা? কারণ, প্রাচ্যের জনগণ আমাদের মতো করে ধর্মকে দেখে না। সুতরাং ইসলাম অসহিষ্ণু ধর্ম হিসেবে, বাক স্বাধীনতার বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল। যদিও এটি ৩০ বছর আগের কথা, আমার এখনও মনে আছে, ইসলাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। দুই তিন বছর পর পর এমন ঘটত আর মুসলিমদের প্রতিক্রিয়ার ফলে ইসলামকে অসহিষ্ণু ধর্ম হিসেবে আখ্যা দেয়া হতো। আমি মনে করি অধিকাংশ প্রাচ্যবাসী এটা বুঝে না। এটি মুসলিম নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তাদেরকেই এটা (মোকাবেলা) করতে হবে।
আমাদের মুসলিম নেতাদের ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যে, নবী মুহাম্মদ (সা.) আমাদের কী বার্তা দিয়েছেন? রাসূল (সা.) কুরআনের সাক্ষ্যদাতা এবং এ কুরআন হলো মুসলিমদের জন্যে গাইড বুক। উপরোন্তু, নবী (সা.)-এর জীবন ছিল প্রকৃতপক্ষে কুরআনের জীবন্ত উদাহরণ। সুতরাং তিনিই (সা.) হলেন আমাদের আদর্শ, যা আমরা করতে চাই। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি ছিল ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল মুসলিম সভ্যতার, যা পরবর্তীতে প্রায় ৭০০ বছর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু এ রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন ছিল? আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু অভিযোগ আশ্চার্যান্বিত করে। যেমন, এটি নারী (অধিকার), সংখ্যালঘু বিরোধী (ধর্ম)। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের সূচনার প্রথম দিনই কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসলামী রাষ্ট্র দুর্বল, বিধবা, এতিম, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, দরিদ্রদের জন্য ট্যাক্স সংরক্ষণ করেছিল। এ রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল সকল আদম সন্তান সমান। তাদের গায়ের রং যাই হোক না কেন। মুহাম্মাদ (সা.) ঘোষণা করেছিলেন, দাসদের সাথে পরিবারের সদস্যদের মতো আচরণ করতে। ফলে মুসলিম বিশ্বে এমন কিছু ঘটেছিল, যা অন্যান্য সভ্যতায় ঘটেনি। মুসলিম বিশ্বে দাস রাজ বংশের আবির্ভাব ঘটেছিল। দাসরা রাজা হয়েছিলেন। মামলুক দাসরা মিশর শাসন করেছিল। এমনকি ইন্ডিয়াও।
ইসলামের নবী (সা.) ঘোষণা করেছিলেন, প্রত্যেকেই তার স্ব-স্ব ধর্ম পালনে স্বাধীন। এটি সবার দায়িত্ব যে, সকল ধর্মের উপাসানলয়কে নিরাপদ রাখা। তিনি আরো ঘোষণা করেছিলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিই ধর্মের ভিন্নতা সত্তে¡ও আইনের চোখে সমান এবং এটি অর্তন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আমি প্রায়শই উদ্ধৃত করি। ইসলামী রাষ্ট্রের চতুর্থ খলিফা এক ইহুদির কেসে হেরে গিয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে, একজন ইহুদি নাগরিকও ছিল অন্যদের মতই। সুতরাং, যখন কোনো মুসলিম সমাজ কোনো সংখ্যালঘুদের সাথে অবিচার করে তা ইসলাম ও তার নবীর (সা.) আদর্শ বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়।
সুতরাং এটি বুঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, নবী (সা.) আমাদের হৃদয়ে বসবাস করেন। যখন তাঁকে (সা.) মৌলবাদী বলা হয় কিংবা অপমান করা হয় তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আমরা জানি, মানুষের হৃদয়ের ব্যাথা শারীরিক ব্যাথার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। আর তাই, মুসলিমরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম তখন একটি কমেডি (রম্য) ফিল্ম তৈরি করা হয়েছিল জিসাস ক্রাইস্ট এর জীবনীর উপর। মুসলিম সমাজে এটি অকল্পনীয়। সুতরাং আমাদের এটি ব্যাখ্যা করা দরকার যে, মানুষ সমাজে, আমাদেরকে অবশ্যই সেসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যা অন্যদের ব্যাথার কারণ হয়। প্রাচ্যে ‘হলোকাস্ট’ অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ এটি ইহুদিদের ব্যাথার কারণ। আমাদের বিষয়টিও ঠিক তেমন। তাই আমরা চাই বাকস্বাধীনতার নামে যেন কেউ কোনোভাবে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) কে অপমান না করে এবং তা আমাদের ব্যাথার কারণ না হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন