শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বিদেশী হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা তৈরীর অপচেষ্টা

প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অসহিষ্ণুতার পাশাপাশি গুম-খুন, ছিনতাই-রাহাজানি, গুপ্তহত্যা বা টার্গেট কিলিং-এর শিকার হচ্ছে সব সম্প্রদায় ও শ্রেণী-পেশার মানুষ। এ ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। মূলত: দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতা না থাকায় এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে দেশে চলমান গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিং-এর ঘটনাগুলো নিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে বিভক্ত পক্ষগুলো যার যার মত করে ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে স্টান্টবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায় গত বছর দেশে ৪ হাজারের বেশী মানুষ হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ১১ জনের বেশী মানুষ অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। বিশেষত: গুপ্তঘাতক ও টার্গেটেড কিলিং-এর তালিকায় বিদেশি নাগরিক, কূটনীতিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পুরোহিত ও বিভিন্ন পেশার মানুষও রয়েছেন। দেশের নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও এ পরিস্থিতিকে জননিরাপত্তার সংকট হিসেবে আখ্যায়িত করে ও উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কাছে আরো বেশী কিছু প্রত্যাশা করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিটি টার্গেট কিলিং-এর পর মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএস দায় স্বীকার করছে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশে আইএস নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব থাকার কথা সব সময়ই জোর দিয়ে প্রত্যাখ্যান করলেও অপরাধি শনাক্ত করতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
দেশে চলমান গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিং-এর সাথে প্রকৃতপক্ষে কারা জড়িত তা’ নিয়ে এক প্রকার ধোঁয়াশা বা অস্বচ্ছতা রয়েছে। এই অস্বচ্ছতার সুযোগ নিয়ে একটি পক্ষ দেশে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। আরেকটি পক্ষ দেশে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের পাশাপাশি বিদেশী হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করার প্রেক্ষাপট তৈরী করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষত: পাবনায় হিন্দু আশ্রমের এক সেবায়েত গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে ক্রীড়ারত মতলববাজ গোষ্ঠির মুখোশ খুলে গেছে। সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পান্ডে নিহত হওয়ার পর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানাদাশ গুপ্ত এবং বিশিষ্ট অভিনেতা পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের রক্ষায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বলে ভারতীয় সরকারী সংবাদ সংস্থা (পিটিআই) পরিবেশিত এক সংবাদ থেকে জানা যায়। প্রতিমাসে যেখানে ৩ শতাধিক মানুষ হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছেন, সেখানে দু’চারজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতেই পারেন। রানাদাশ ও পীযুষরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জননিরাপত্তার সংকট নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের বদলে ভারতের হস্তক্ষেপ কামনার মধ্য দিয়ে কুচক্রীদের থলের বেড়াল বের করে দিয়েছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের রক্ষার নামে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় হস্তক্ষেপের পথ সুগম করতেই একটি পক্ষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যার নেপথ্যে কাজ করছে কিনা সে প্রশ্নও এখন উঠে আসছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে এদেশেরই কিছু হিন্দু নেতা ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে খোদ ভারতে প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সংঘাতের হার বেড়েই চলেছে। গত বছর প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের প্রথম ৬ মাসে ভারতে ৩৩০টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত এবং সহস্রাধিক আহত হয়েছেন, যা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশী হলেও ২০১৪ সালে সারা বছরে ৬৪৪টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৯৫ জন নিহত এবং প্রায় ২ হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। হাজার বছর ধরে বাংলাদেশে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধই এই শান্তি ও সহাবস্থানের মূল চালিকাশক্তি। এ দেশের কোন রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উগ্রসাম্প্রদায়িক এজেন্ডা নেই। তবে ব্যক্তিগত স্বার্থে অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি বা সম্পত্তি দখলের লক্ষ্যে একশ্রেণীর মানুষ তাদের উপর ক্ষমতার অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ট্রাস্টের নেতারা গত বছর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে অভিযোগ করেছেন, দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বেদখল হওয়া সম্পত্তির ৯০ ভাগই দখল করেছে আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধর্মের দুর্বল শ্রেণীর মানুষই প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের দ্বারা নির্যাতন ও অপদখলের শিকার হচ্ছে। একে আলাদা করে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখার কোন সুযোগ নেই। দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং অসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে, তখন এ নিয়ে দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহল যার যার স্বার্থে অপরাজনীতিতে লিপ্ত হতে পারে। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন অংশ আভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চেতনা বিনাশী, অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপঘাত হিসাবে ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করলে তা’ দেশপ্রেমিক মানুষকে বিক্ষুব্ধ করার সাথে সাথে দেশে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিং-এর বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে আটকের মধ্য দিয়ে দেশে এক ধরনের আতঙ্কজনক অবস্থা তৈরী হয়েছে। একই সময়ে হিন্দু সেবাশ্রমের সেবায়েত, হিন্দু শিক্ষককে হত্যা চেষ্টা এবং রামকৃষ্ণ মিশনের পুরোহিতকে হুমকি দিয়ে একটি নেপথ্য শক্তি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে বলে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। দেশের শান্তি ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়, সকল রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন