শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দেশে এসব কি হচ্ছে?

প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এখন চলছে পবিত্র মাহে রমজান। ৯১ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যখন সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাদের চিত্তের পরিশুদ্ধি করছেন, তখন চিত্রের অপর পিঠে দেখা যাচ্ছে লাশের মিছিল। পত্র-পত্রিকায় দাবী করা হয়েছে, গুপ্ত ঘাতকদের চাপাতি ও ছুরির আঘাতে গত কয়েক মাসে নিহত হয়েছেন ৪৮ জন মানুষ। এদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এবং বিদেশীসহ সব শ্রেণীর নাগরিক রয়েছেন। গত বুধবার ঢাকায় এক ইফতার মাহফিলে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিশ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, গত কয়েক দিনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছেন ৫০ জন। মাত্র কয়েক মাসে শুধুমাত্র গুপ্ত হত্যা ও ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছেন ৯৮ জন মানুষ। এর কয়েকদিন আগে ৬ পর্বে ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সে নির্বাচনে নিহত হয়েছেন ১৪২ জন। সুতরাং বলাই যায়, বাংলাদেশে এখন চারিদিকে শুধু লাশের মিছিল। দেশপ্রেমিক এবং বিবেকবান মানুষ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করছেন, দেশে এসব কি হচ্ছে? সবচেয়ে আতঙ্কের কথা হলো, শত শত লাশ পড়ছে অথচ খুন খারাবির দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ। তাহলে কারা এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে? গতকাল বৃহস্পতিবার ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, যশোরে ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামে ৩ ব্যক্তি নিহত হয়। কপোতাক্ষ নদীর তীরে বঙ্গবন্ধু পার্কে স্থানীয় জনগণ গত বুধবার সকালে ৩টি লাশ দেখতে পায়। পুলিশ দাবী করেছে, এই ৩ ব্যক্তি ছিলো ডাকাত। তারা কৃষ্ণনগরে ডাকাতি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তখন জনগণ তাদের ধরে ফেলে এবং গণপিটুনিতে হত্যা করে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ জানায়, তারা এই ধরনের কোনো ডাকাতি অথবা গণপিটুনিতে ৩ ডাকাত নিহত হওয়া সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, যারা নিহত হয়েছে তাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক এই বিষয়টিও জানা যায়নি যে, তাদেরকে কি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, নাকি গণপ্রহারে হত্যা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গত সোমবার রাতে ঝিকরগাছা থানার সহকারী সাব ইন্সপেক্টর তৌহিদুল ইসলাম ডাকাত দল কর্তৃক ছুরিকাহত হন।
একই দিনে দেশের তিনটি জেলায় আইন-শৃঙখলা বাহিনীর সাথে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধে ৩ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এদের দু’জনের নাম রুবেল হোসেন এবং জীবন। নিহত অপর ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি। ঈশ্বরদী থানার এ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর সুজাউল ইসলাম সুজার হত্যাকা-ে পুলিশ রুবেল হোসেনকে প্রধান আসামী করেছিলো। সুজাউল ইসলাম সুজাকে গত বছরের ৫ অক্টোবর পাকশী রেল  স্টেশন সংলগ্ন মাঠে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঈশ্বরদী থানার ওসি বিমান কুমার দাস বলেন, গত মঙ্গলবার রাত ১১টায় রুবেলকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। রাত ১১টা ৩০ মিনিটে রুবেল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। একই রাত ২টার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জীবন নামে ৩০ বছরের এক ব্যক্তি নিহত হয়। অনুরূপভাবে যশোরে যে ব্যক্তি নিহত হয় তার পরিচয় জানা যায়নি। গতকালের ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয় যে, গত ৭ই জুন থেকে ১৫ই জুন, এই ৯ দিনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৬ জন। এদের মধ্যে জঙ্গি সন্দেহে নিহত হয়েছে ৫ জন। রোজা রমজানের দিনে এমন হত্যাকা- এবং লাশের মিছিল অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। মানুষ আশা করেছিলেন যে, পবিত্র মাহে রমজানে অন্তত এই ধরনের রক্তপাত ঘটবে না। চিত্রের আরেকদিক অত্যন্ত ভয়াবহ। জঙ্গি এবং অপরাধী দমনের নামে বিগত ৬ দিনে ১২ হাজারেরও বেশী মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গির সংখ্যা ১৭০ জনেরও কম। অবশিষ্ট প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তিকে কেন এমন পাইকারি হারে গ্রেফতার করা হলো তার সদুত্তর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখনো দিতে পারেনি। অন্যদিকে প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে ৩ হাজার ব্যক্তির গ্রেফতার নিয়ে দেশে এবং বিদেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা এমন কি ভারতের পত্র-পত্রিকাতেও এই ধরনের হাজার হাজার ব্যক্তির পাইকারি গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইতোমধ্যেই দেশের কারাগারগুলোতেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, কারাগারসমূহের ধারণ ক্ষমতা ৩৪ হাজার ৭০৬। সেখানে বন্দীর সংখ্যা ৭৩ হাজার ৩০০। এর মধ্যে আবার প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজার বন্দী ঢুকানো হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বন্দীদেরকে কারাগারের রুমগুলোতে রাখার জায়গা না থাকায় তাদের কাউকে কাউকে বাথরুমে রাখা হচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে যা ঘটবার তাই ঘটছে। বন্দীদের ভালো রাখা এবং ছেড়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে বেপরোয়া দুর্নীতি। মিডিয়ার ভাষায় এগুলোকে বলা হচ্ছে “গ্রেফতার বাণিজ্য।”  ইংরেজী ডেইলি স্টার গত ১৫ জুন বুধবার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদের যে শিরোনাম করেছে সেটি হলো, “গ্রেফতার বাণিজ্য চলছে”। প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত এই খবরে গ্রেফতার করা এবং ছেড়ে দেওয়া নিয়ে পুলিশ আটক ব্যক্তিদের সাথে ঘুষ নিয়ে যে দর কষাকষি করছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কতগুলো উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যে মুহূর্তে পুলিশের মহাপরিদর্শক গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন সেই মুহূর্তে এই ইংরেজী পত্রিকাটি ঘুষ লেনদেনের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কেস তুলে ধরেছে। এই তো মাত্র সেদিন বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, সাদা পোশাকে গ্রেফতার এবং রিমা- সম্পর্কে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলো সেই রায়টি বহাল রেখেছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের ঐ রায়ে গ্রেফতার এবং রিমা- সম্পর্কে ১৫ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঐ ১৫ দফা নির্দেশনা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বহাল রেখেছে। অথচ এই রজমান মাসে সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনের নামে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হচ্ছে; সুপ্রিমকোর্টের উপরোক্ত নির্দেশনা সমূহের প্রতি কোনোরূপ তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
সব কিছু মিলে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ, উদ্বেগ এবং আতঙ্কজনক। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ ড. বদরুদ্দীন ওমর এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার যা করছে সেগুলোর উদ্দেশ্যে জঙ্গি দমন নয়, সরকারের আসল উদ্দেশ্যে হলো বিরোধী দল ও মত দমন করা এবং দেশ জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ইতোমধ্যে ‘জঙ্গি’ নামে গ্রেফতারকৃত বেশ কয়েকজনকে বন্দুকযুদ্ধের আড়ালে বিচারবর্হিভূত হত্যা করা হয়েছে। এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়। দিনের পর দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এই পরিস্থিতির আর অবনতি ঘটতে দেওয়া যায় না। জনগণ মনে করে এই ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করার সময় এসেছে। বিষয়টি নিয়ে তাকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার আগেই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন