ফুটপাত আর রাস্তার মধ্যে যে একটা সম্পর্ক আছে সেটা আমাদের কারো অজানা নয়। যেখানে রাস্তা আছে সেখানে ফুটপাত থাকবেই। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, রাস্তায় ফুটপাত খুঁজে পাওয়াটাই অস্বাভাবিক। ফুটপাত এখন চোখেই পড়ে না সাধারণ মানুষের। আর পড়বেই বা কেন? এখনতো ফুটপাত মানেই মার্কেট। ছোটখাট মার্কেট এখন ফুটপাতেই তৈরি হয়ে যায়। আর ক্রেতারা সেখানে ভিড় করে দখল করে ফেলে পুরোটাই। এতে হাঁটার কোনো অবস্থাই থাকে না। কিন্তু আফসোস করতে হয় যখন রাস্তায়ও পথচারীরা হাঁটতে পারে না। রাস্তার পাশগুলোতে এখন গাড়ি পার্কিং আর হকার বাণিজ্য চলে। মোটকথা হাঁটার পথ সংকীর্ণ।
শুধু তাই নয়, মানুষ রাস্তায় নেমে আসার কারণে সৃষ্টি হয় যানজট। একদিকে ফুটপাত দখল অন্যদিকে রাস্তায় গাড়ি পার্কিং। পথচারীরা যাবে কোথায়? ফুটপাতের দোকানগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে যেন এগুলো দোকন বসানোর জায়গা। চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, জুবলী রোড, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর দুইনম্বর গেইট, অক্সিজেন মোড়, জিইসি মোড়, অলংকার, কর্ণেল হাট, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়, এক্সেস রোড, ইপিজেড মোড়সহ নগরীর প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, ফুটপাত ও মূল সড়ক দখল করে শত শত হকার নানা পণ্যের ব্যবসা খুলে বসেছে।
বিশেষ করে চট্টগ্রাম নিউ মার্কেট এলাকায় ফুটপাত ছাড়িয়ে দুই পাশের ৬ থেকে ৭ ফুট রাস্তা দখল করে পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। একই অবস্থা দুই নম্বর গেইট, ইপিজেড ও আগ্রাবাদ এলাকায়। প্রকাশ্যে কোন ধরনের বাধা ছাড়াই হকাররা মূল সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গার্মেন্ট সামগ্রী, ফলমূল, শাক-সবজি, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, তৈরি পোশাক, জুতো ইত্যাদি পণ্যের ব্যবসা খুলে বসেছে। শুধু তাই নয়, মহাসড়কও বাদ পড়েনি। নগরীর কর্ণেল হাট, বহদ্দার হাট, মুরাদপুর এলাকায়ও মহাসড়কের রাস্তা দখল করে ব্যবসা খুলে বসেছে। মূল সড়ক দখল হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ ও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হলেও কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সিটি করপোরেশনের দুই একটি বিচ্ছিন্ন অভিযান ছাড়া এ পর্যন্ত কোন মহল কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কোতোয়ালি থানা মোড় থেকে স্টেশন রোডের বিআরটিসি মোড় এবং নিউমার্কেট থেকে এনায়েত বাজার মসজিদ পর্যন্ত পোশাকের পাশাপাশি মৌসুমি ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। জিইসির মোড়ের চারপাশের কয়েক কিলোমিটার ফুটপাতজুড়ে বসেছে ফল, কাপড়, জুতাসহ বিভিন্ন দ্রব্যের দোকান। দুই নম্বর গেট এলাকায় মূল সড়কের দুই পাশে রয়েছে ফল, পোশাক, জুতা ও কসমেটিকস ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্ব। চৌমুহনী থেকে আগ্রাবাদ বিদ্যুৎ অফিস পর্যন্ত জুতা, জামা-কাপড়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। ইপিজেড এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার ফুটপাত দখল নিয়ে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়েছে।
এছাড়া বিমানবন্দর সড়ক, কাঠগড়, রাস্তার মাথা, স্টিলমিল বাজার, দেওয়ানহাট, স্টেশন রোড, লালদীঘির পাড়, জামাল খান, অলঙ্কার মোড় এলাকার ফুটপাত দখলের পাশাপাশি সড়কের ৪ থেকে ৫ ফুট পোশাক ও বিভিন্ন ফলমূলের হকাররা দখল করে ফেলেছে।
চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার ফেডারেশনের তথ্যানুযায়ী, নগরীতে হকার রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এদের নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি সংগঠন। এগুলো হলো চট্টগ্রাম হকার্স লীগ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হকার সমিতি ও চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার সমিতি। এ তিনটি সংগঠন মিলে চট্টগ্রাম সম্মিলিত হকার ফেডারেশন। এসব সংগঠনের বাইরেও রয়েছে ৬ থেকে ৭ হাজার ভাসমান হকার।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরীতে প্রায় ২৫টি প্রধান সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে অনেক সড়কে ফুটপাত এখনও তৈরি হয়নি। নগরীতে পাকা সড়ক রয়েছে ৪২৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার সড়কে ফুটপাত নেই। বাকি সড়কের উভয় পাশ মিলে ফুটপাত রয়েছে ৫৫৬ কিলোমিটার। যার অধিকাংশই হকারদের দখলে। কোনো কোনো স্থানে ফুটপাত ছাড়িয়ে মূল সড়কে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কের পাশে ফুটপাত প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রতিটি সড়কে ফুটপাত নেই। যে পরিমাণ ফুটপাত আছে তাও বিভিন্ন মহলের দখলে। সড়ক হচ্ছে যানবাহন চলাচলের জন্য। আর ফুটপাত হচ্ছে মানুষ পায়ে হাঁটার জন্য। উন্নত বিশ্বে ফুটপাত দিয়ে প্রতিবন্ধীরাও নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে। প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার উঠা-নামা এবং চলাচলের সুযোগ রাখা হয়। আর আমাদের দেশের ফুটপাতগুলো যেন মরণ ফাঁদ। এ ক্ষেত্রে কোন নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ফুটপাতে দুই হুইল চেয়ার পাশাপাশি চলাচলের জায়গা রাখতে হবে। আবাসিক এলাকার ফুটপাতের প্রশস্থতা থাকবে সর্বোনিম্ন ১০ ফুট।
বাণিজ্যিক এলাকার ফুটপাত হবে আবাসিক এলাকার চেয়ে বেশি প্রশস্থ। নগরীর ফুটপাতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের দখলের পাশাপাশি রয়েছে ডাস্টবিন, ম্যানহোল, বিলবোর্ডসহ নানা কিছু। দখল আর ঝুঁকির কারণে সাধারণ মানুষ ফুটপাত বাদ দিয়ে এখন মূল সড়ক দিয়ে চলাচল করছে। এই সমস্যা নতুন কিছু নয়। অথচ কোন মহলের পদক্ষেপ না থাকায় ফুটপাতের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। আবার ফুটপাত এবং সড়কের হকারদের রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগও রয়েছে। পিডিবির দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এসব অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়।
হকার ছাড়াও কোনো কোনো জায়গায় রাস্তার উপরেই নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত রড সোজা করা এবং সিমেন্ট এবং বালু মাখানোর কাজও করা হয়। এতে যেমন পথচারীদের হাঁটায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয় আবার গাড়ি চলাচলের গতিও কমে যায়। সিটি কর্পোরেশন বহুবার রাস্তা ও ফুটপাতের উপর দোকান সরানোর জন্য অভিযান পরিচালিত করেছে। কিন্তু, ফলাফল শূন্যই থেকে গেছে। শূন্য থাকার পেছনে অবশ্য কিছু কারণও রয়েছে। বড় কারণ প্রভাবশালীদের প্রভাব। কেননা, তারাই টাকার বিনিময়ে ফুটপাতে হকার বসার সুযোগ করে দেন। কিন্তু, যারা আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন বানান, তারা নিজেরা প্রভাবশালী। তাই রাস্তা-ফুটপাত দখল করে নির্মাণ সামগ্রী রাখতে তাদের কারো কাছে জিজ্ঞাস করতে হয় না। বরং কেউ কিছু বলতে গেলে নিজেরাই বিপদে পরেন। ফলে এই ধরনের দখলের সংখ্যাও প্রচুর বাড়ছে।
আমি যদি আমার এলাকার কথা বলি, সিটিগেট থেকে পাকা রাস্তার মাথা পর্যন্ত কোনো ফুটপাত নেই। এতেও সমস্যা হতো না, যদি রাস্তার একাংশে ট্রাক-লরি না থাকতো। পুরো রাস্তার এক তৃতীয়াংশ ট্রাক আর বড় বড় কাভার্ডভ্যানের মাধ্যমে দখল থাকে। বাধ্য হয়ে পথচারীরা রাস্তার মাঝখানে চলাচল করে। বড় ঝুঁকির বিষয় হচ্ছে এ পথে চলাচল করে ঢাকা, কুমিল্লাসহ উত্তরবঙ্গের সকল গাড়ি। যা অনেক গতিতে চলাচল করে। গাড়িগুলো সিটিগেট থেকে এমন গতিতে চলাচল করে যা খুব ভয়ংকর। এসব গাড়ি পথচারীদের সাথে হালকা র্স্পশ হলেই নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করে নিতে হবে। এ পর্যন্ত সিটিগেটের আশেপাশে এসব উচ্চগতির গাড়ি অনেক জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
একদিকে বেপরোয়া গাড়ি অন্যদিকে ফুটপাত দখল করে চলছে হকারদের ব্যবসা। কী অসহনীয় অবস্থা! পথচারীদের জন্য এটা একটি সীমাহীন দুর্ভোগ। কিন্তু আর কতকাল এ দুর্ভোগে থাকবে পথচারীরা?
লেখক: প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন