শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সীমান্তে হত্যাকান্ড : পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্য

| প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারে’র এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ৯ মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ’র হাতে ২৮ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে ও ১৭ জন অপহৃত হয়েছে। এই হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে ৩ জনের বেশি বাংলাদেশী নিহত ও প্রায় ২ জন অপহৃত হয়েছে। এটা নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক। সীমান্তে বিএসএফ’র বাংলাদেশী হত্যা ও অপহরণ নিয়মিত ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রতি বছরের হত্যা ও অপহরণের পরিসংখ্যান তারই সাক্ষ্য বহন করে। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সীমান্তহত্যার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অবস্থান শীর্ষে। ওই সীমান্তকে কোনো এক প্রতিবেদনে মৃত্যুর উপত্যকা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের তরফে বিভিন্ন সময়ে সীমান্তহত্যার বিষয়ে ভারতের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাকিদ দেয়া হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নানা পর্যায়ের বৈঠকে, এমন কি শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টি বাংলাদেশ তুলেছে। ভারতের তরফে বরাবরই আস্বস্থ করে বলা হয়েছে, সীমান্তহত্যা শূণ্যে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু এ আশ্বাস কখনোই কার্যকর হয়নি। সীমান্তে হত্যাকান্ড অবিরাম চলছে। এই সঙ্গে চলছে অপহরণ। যখন তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ, শস্য ও গবাদী লুণ্ঠন, গোলাগুলি ইত্যাদি বিএসএফ’র নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার স্পর্ধা এতটাই বেড়েছে যে, বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের পর্যন্ত অপহরণ করতেও দ্বিধা করেনা। সম্প্রতি এরকমই এক ঘটনায় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের আশাবাড়ি এলাকার সীমান্ত থেকে র‌্যাবের ৩ সদস্যসহ ৫জনকে তুলে নিয়ে যায়। পরে বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠকের পর বিএসএফ তাদের ফেরৎ দেয়।

সীমান্তে যখন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাই নিরাপদ নয় তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটা অনিশ্চিত, সহজেই অনুধাবন করা হয়। অথচ বাংলাদেশের তরফ থেকে দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ এমন ‘ভাষ্য’ দেন, যাতে দু:খ রাখার কোনো জায়গা থাকেনা। ভারতের কথামতে, সীমান্ত হত্যার জন্য বাংলাদেশীরাই মূলত দায়ী। তারা অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করে। কখনো গরু বা চোরাই মালামাল আনতে যায়। এই যাওয়া-আসার সময় বিএসএফ’র গুলির মুখে পড়ে এবং কখনো কখনো কেউ কেউ মারা যায়। এটা ভারতের পূর্বাপরের ভাষ্য। এর সঙ্গে বাস্তবতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ কখনো কখনো বাংলাদেশের দায়িত্বশীলদের মুখেও এই ভাষ্যই পুনরাবৃত্ত হতে দেখা যায়। এর চেয়ে বিব্রতকার আর কিছু হতে পারেনা। গত পরশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ সম্পর্কে যা বলেছেন, তাকে দু:খজনক বললেও বেশি বলা হয়না। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধে ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ না করে নিজেদের দায়িত্বশীল হতে হবে। সম্প্রতি সীমান্তে হত্যাকান্ড কমেছে বলে দাবি করে তিনি আরো বলেন, সীমান্তে হত্যাকান্ড উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আর যারা মারা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই অবৈধভাবে ভারতে যায়। চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। অবৈধভাবে ভারতে যাওয়া কমালে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য সেটা অভিজ্ঞমহল বিবেচনা করবে। তবে ভুক্তভোগী মানুষ এই বক্তব্যকে বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রীর বক্তব্য বলে মানতে রাজি হবে না। তাদের মনে হবে, এটা ভারতের কোনো মন্ত্রীর বক্তব্য। ধরা যাক, সীমান্তে অনুপ্রবেশের বাস্তবতা বিদ্যমান এবং যারা অপ্রবেশ করে তাদের অনেকে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এটা একতরফা নয়। অনুপ্রবেশকারী ও চারাচালানের সঙ্গে যুক্তরা কেবলই বাংলাদেশী নয়, ভারতীয়ও আছে। সেক্ষেত্রে বিজিবি’র হাতে ভারতীয় নাগরিকদেরও হরহামেশা নিহত হওয়ার কথা। সেটা হয়না কেন? বিজিবি যথাযথ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়, যেটা বিএসএফ দেয় না। এটাই এর উপযুক্ত উত্তর হতে পারে।

ফেলানী হত্যার কথা কারো অজানা নেই। বাংলাদেশী এই কিশোরীর কাঁটাতারের বেড়া থেকে গুলি করে হত্যা করেছিল বিএসএফ’র সদস্যরা। হত্যা না করে তাকে গ্রেফতার করা যেতো। তার অপরাধের যথোচিত বিচার হতে পারতো। এই ঔচিত্যবোধের এতটুকু পরিচয় বিএসএফ’র কাছ থেকে পাওয়া যায়না। ফেলানী হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে তোলপাড় উঠেছিল। বিচারের দাবি উঠেছিল। বিচার ঠিকই হয়েছে, তবে ঘাতক বিএসএফ সদস্য বেসকসুর খালাস পেয়েছে। বলা বাহুল্য, হত্যাকারী, অপহরক ও লুটেরা বিএসএফ সদস্যদের যদি উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে সীমান্তে এই বেপরোয়া হত্যাকান্ডের ঘটনা বছরের পর বছর ঘটতে পারতো না। সীমান্তে যেসব হত্যাকান্ড ঘটছে তা আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। দেশের অভ্যন্তরে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটছে। অধিকারের আলোচ্য প্রতিবেদন থেকেই জানা গেছে, একই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ৩১৫টি। এর মধ্যে ৩০৬ জন তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। একজনকে পিটিয়ে ও ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাকী ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনে। এ সময়ে গুমের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি ও আর কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৪৯ জনের। বলার অপেক্ষা রাখেনা, মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। সেক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অনাকাঙ্খিত। যত বড় অন্যায়কারী ও অপরাধীই হোক না কেন, তাকে বিনা বিচারে হত্যা নয়, বিচার করে যে কোনো শাস্তি নিশ্চিত করাই আইন ও সভ্যতার দাবি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন