বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তাহলে আইন করে ভিন্নমত প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হোক

জাকারিয়া জাহাঙ্গীর | প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (তড়িৎকৌশল) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন আবরার ফাহাদ। আবরার হয়তো জানতেন না, প্রতিবাদী বাক্য উচ্চারণই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তিনি জানতেন না, এতোটাই অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা ও হত্যাকান্ডের অলিখিত অধিকার ছাত্রলীগের। গণমাধ্যমে এসেছে, ভারতকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার আগে তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে শিবির আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তবে কি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সব কর্মকান্ডের গোয়েন্দা নজরদারি কিংবা সকলের ফেসবুক স্ট্যাটাস পর্যবেক্ষণের দায়িত্বও পালন করে ছাত্রলীগ? তিনি কি দেশবিরোধী কোনো অপপ্রচার করেছিলেন? নাকি সরকার ও ছাত্রলীগ নিয়ে আপত্তিকর কোনো মন্তব্য করেছিলেন যে, তাকে হত্যাই করতে হবে?

আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ তাকে ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী প্রথম বাংলাদেশি শহিদ হিসেবে মন্তব্য করেছে। তবে এটা সত্য যে, দেশের স্বার্থে প্রতিবাদ করায় হত্যার শিকার হয়ে তিনি অমর হয়ে গেলেন। তার মৃত্যু বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের শক্তি হিসেবে মনে করছে, হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনে শিক্ষকরাও অংশগ্রহণ করেছেন। হত্যার সাথে জড়িত বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুস্তাকিম ফুয়াদসহ কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে। বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউশ সানি হত্যাকান্ডের সাথে ছাত্রলীগ নেতাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। কমিটির অধিকাংশ নেতার এহেন অন্যায়ের কারণে সহসাই তার পদত্যাগ করা উচিৎ ছিলো, কিন্তু তিনি তা করেননি। কেন্দ্রীয় সংগঠন কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তবে তাদের বিরুদ্ধে স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের পেছনে ইন্ধনদাতা কারা, তাও বের করতে হবে। ভবিষ্যতে এরা কেউ যেনো এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবার কোনো সুযোগ না পায় কর্তৃপক্ষকে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ও দায় এড়াতে পারে না।

ফেসবুকে আবরার বাংলাদেশের প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশ ভারতের কাছে কলকাতা বন্দর ব্যবহারের অনুরোধ করেও না পাওয়া ও এখন বাংলাদেশের মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের আবদার, ভারতকে চাহিদামতো ফেনী নদীর পানি দেওয়া, গ্যাস সুবিধা দেওয়া, বাংলাদেশ অভিমুখে অসময়ে ফারাক্কার পানির দেওয়া ও ভারতকে বাংলাদেশের ইলিশ উপহার দেওয়ার বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন। সরকার দেশে অবাধ তথ্য প্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বললেও শুধুমাত্র ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে সরকারদলীয় অঙ্গ সংগঠনের লোকজনই তাকে হত্যা করলো, যা কখনোই কাম্য ছিলো না। প্রতিটি সচেতন মানুষ জানেন, আবরার যা লিখেছিলেন, তা সত্য নাকি মিথ্যা। তিস্তার পানির সুসম বণ্টন দীর্ঘদিনেও হয়নি। ভারত বারবার অসময়ে ফারাক্কার বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলে। অথচ আমরা ঠিকই ফেনী নদীর দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি ভারতকে দিচ্ছি। তাদের কয়লা ও পাথর আমাদের দেওয়া বন্ধ করে দিলেও আমরা গ্যাস দিতে যাচ্ছি। এবারের শারদীয় দূর্গোৎসব উপলক্ষে আমরা ভারতকে ৫০০ মে. টন ইলিশ শুভেচ্ছা উপহার প্রদান করলেও তারা এ দেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে দেশে পেঁয়াজের দাম এখন আকাশছোঁয়া। তাদেরকে ট্রানজিটসহ বিভিন্ন চুক্তিতে পর্যাপ্ত সুবিধা দিলেও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সুযোগে তারা নিজেদের কখনো কখনো প্রভূত্বের আসনে দাঁড় করায়। এসব বিষয়ে নীতিগতভাবে যে কেউ যে কোনোভাবে প্রতিবাদ করতে পারে। তবে কারো প্রতিবাদ যদি অযৌক্তিক, অন্যায় বা দেশবিরোধী হয়, তবে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।

মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারকে প্রকাশ্য হত্যা করা হলেও কেউ এগিয়ে না আসাটা সমাজের জন্য লজ্জা ও বুয়েট প্রশাসনের জন্য চরম ব্যর্থতা। ভবিষ্যতের জন্য বুয়েট নিরাপত্তাহীন ক্যাম্পাস হিসেবেই জাতির কাছে কলঙ্কের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আবরারের হত্যাকান্ডস্থল বুয়েটের ২০১১ কক্ষটি ছাত্রলীগ ‘টর্চার সেল’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে এলেও কর্তৃপক্ষ তা জানে না- বললে ভুল হবে। শুধু বড় ধরনের ঘটনা ঘটলেই তা নিয়ে তোলপাড় চলে, সবাই তৎপর হয়; তার আগে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে, যা বাংলাদেশের কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতোদিন কীভাবে কক্ষটি প্রকাশ্য অপকর্মের অলিখিত কার্যালয় হিসেবে ছিলো, এ জবাবের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি। এখানে ইতোপূর্বে কী কী অন্যায় সংঘটিত হয়েছে, তা একে একে বের করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশে তথ্য অধিকার আইন আছে, আবার সে অধিকার খর্ব করার প্রভাবশালী মহলও আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, আবার ভিন্নমত দমনে বিভিন্ন আইনের অপপ্রয়োগও চলছে। বিশেষ করে বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে সাত-পাঁচ না ভেবে কোনোকিছু প্রকাশ করা অকাল বিপদের কারণ। ফলে ‘নিজের পায়ে কুড়াল মারা’র মতো বিপদে পড়ার ভয়ে সত্য ও ন্যায়সঙ্গত অনেক বিষয়েই সবাই আর কথা বলতে চান না। দেশের অগণিত সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম থাকা সত্তে¡ও অনেক ঘটনাই ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’র দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়- তা অস্বীকার করবার সুযোগ নেই। আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় সংবাদমাধ্যমগুলো সমাজের অনেক সংবাদ এড়িয়ে গেলেও সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। ফেসুবক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জারসহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলো অনেকটা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বর্তমান সময়ে ‘প্রতিবাদের আদর্শ স্থান’ হিসেবে মনে করা হয়। অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হওয়া বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যম তৎপর এবং রাষ্ট্র সজাগ হয়। সেই হিসেবে ‘রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভ’ সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু শক্তিশালী এ মাধ্যমের প্রতিবাদকে গলাটিপে ধরলে হয়তো প্রতিবাদের ন্যূনতম ভাষাও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলবে মানুষ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনের পক্ষে বিদেশি গণমাধ্যমে বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম বক্তব্য দেওয়ায় তার প্রতি যে রাষ্ট্রীয় খড়গ নেমে এসেছিলো, তা কেউ ভোলেনি। শিক্ষার্থীদের ওপরও নির্যাতনের মাত্রা কম ছিলো না। কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তরুণদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। অথচ বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ও উগ্র ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে প্রিয়া সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বিচারের জন্য ধর্ণা দিলেও তার ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে দেশবাসী মত প্রকাশের স্বাধীনতার সংজ্ঞাকে এখন ক্ষেত্রবিশেষ ভিন্ন ভিন্ন মনে করেন। তাই মত প্রকাশের অধিকার যদি ক্ষেত্রবিশেষ আলাদা হয়, ভিন্নমত প্রকাশ যদি অপরাধ হয়, আর সে অপরাধের শাস্তি যদি হত্যা বা নির্যাতন হয়; তবে আইন করে ভিন্নমত প্রকাশের পথ বন্ধ করা হোক। মানুষ এটা অন্তত বুঝতে পারবে, ‘জ্বি হুকুম জাহাপনা’ ছাড়া করবার কিছু নেই।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন