বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আবরার হত্যাকান্ড এবং উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ভূ-রাজনীতি

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লী সফরটি নানা কারণে আলোচিত ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যৌথ নদী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সামনে মূলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা পরস্পর সফর বিনিময় করছেন, দেশের মানুষের প্রত্যাশার কথা মনে রেখে উভয় পক্ষই একটা অস্পষ্ট আশাবাদ জিইয়ে রেখে তাদের সফরে নানা প্রসঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে চুক্তি ও সমঝোতাস্মারক সই করে নতুন নতুন কর্মউদ্যোগের সূচনা করলেও তিস্তার প্রসঙ্গ অধরাই রয়ে যায়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিস্তাপাড়ের কোটি মানুষের হাহাকার, লাখ লাখ কৃষকের হাপিত্যেশ, লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি মরুময় হয়ে উঠার বাস্তবতা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেনা। গত এক দশকে ভারতকে তার চাহিদার সম্ভাব্য সবকিছুই দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা ভারতকে যা দিয়েছি তার জন্য আজীবন মনে রাখতে হবে। গঙ্গার পানি বন্টনে একটা চুক্তি হলেও সেই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ কখনো পানি পায়নি। পানিচুক্তি অনুসারে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে যৌথ নদী কমিশন নামের একটি কমিশন গঠিত হলেও ভারতের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারণে বছরের পর বছর ধরে সেই কমিশনের কোনো বৈঠক হয়না। এমনকি বর্ষায় বাঁধের ওপারে ভরে ওঠা পানি কমিয়ে উজানে বন্যা ঠেকাতে ফারাক্কা বাঁধের সুইস গেটগুলো একযোগে খুলে দেয়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। ফলে হঠাৎ খুলে দেয়া ফারাক্কার পানিতে তলিয়ে যায় পদ্মা পাড়ের কোটি কোটি মানুষের জনপদ ও লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি। আকষ্মিক বানের পানিতে নদীগুলোর দুপাড় উপচে বন্যা ও ভাঙ্গনে প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার বাস্তুহীন, নি:স্ব হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক নদী আইনের বাধ্যবাধকতার প্রশ্নের বাইরেও এখানে সুপ্রতিবেশী বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোনো দায়বদ্ধতাই খুঁজে পাওয়া যায়না। যৌথ নদীর উজান থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পানি প্রত্যাহার করে একদিকে নদীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে উজানের ঢল ঠেকাতে সুইসগেট খুলে দিয়ে নাব্যতা হারানো নদীকে বন্যা ও ভাঙ্গনের মুখে ঠেলে দেয়ার অমানবিক আচরণ চলছে বছরের পর বছর ধরে। এসব বাস্তব চিত্র দুই বাংলার মানুষের অজানা নয়। এমনকি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পক্ষ থেকেও এখন ফারাক্কা বাঁধ ডিকমিশন করার দাবী উঠছে। ভারতের ফারাক্কা, গজলডোবা বাঁধ, আন্তনদী সংযোগের কারণে ভাটির দেশ বাংলাদেশ পানির অভাবে শুকিয়ে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হলেও তাদের মধ্যে কোনো মানবিকতার উদ্রেক হয়না। কিন্তু বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নদী ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের জন্য তারা মানবিক দিকগুলো যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। গঙ্গা-তিস্তার বঞ্চনা এদেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করে। যখন দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রী দিল্লী সফরে গিয়ে ফেনী নদী থেকে ভারতকে ১.৮ কিউসেক পানি প্রত্যাহারে ভারতের সাথে চুক্তি সই করেছেন, তখন সেই ব্যথা বেদনা ও সংক্ষোভ আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। আর সেই সংক্ষোভের প্রতিফলন মূলধারার গণমাধ্যমে যেমন পড়ে,তার চেয়ে বহুগুন বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ফেইজবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের ফেইজবুক স্টাটাসে সেই প্রতিক্রিয়াই দেখা গেছে। দেশের লাখ লাখ মানুষ এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আবারার হত্যার পর সেই প্রতিক্রিয়া যেন গণবিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে।

ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার বা বঙ্গোপসাগরে ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে রাডার স্থাপনের মত ইস্যু নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত এ দেশের মানুষ তা জানতেও পারেনি। এসব বিষয়ের স্ট্রাটেজিক ফলাফল নিয়ে সংসদে বা সরকারের কোনো ফোরামে কোনো আলোচনাও হয়নি। আলোচনা বা বিচার-বিশ্লেষণ না হওয়ায় এ নিয়ে জাতি বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় । তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে রাষ্ট্রের পক্ষে কোনো কিছই আর গোপণ রাখা সম্ভব নয়। আবরার হত্যার পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, পানি বন্টনে বঞ্চনা এবং অসম বাণিজ্য, ট্রানজিট ও নিরাপত্তাচুক্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন প্যানডোরার বাক্স খুলে গেছে। সেই সাথে দেশের ছাত্র রাজনীতিতে নির্মম বর্বরতা, শিক্ষা প্রশাসনের দেউলিয়াত্ব এবং মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের দানবীয় শক্তির কাছে সবকিছু বিসর্জনের করুন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। আবরার হত্যায় অভিযুক্ত বেশিরভাগই ইতিমধ্যে ধরা পড়েছে। তাদের অনেকে ৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ নির্বিশেষে দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের ফাঁসির দাবী জানাচ্ছে। অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই আওয়ামী ছাত্রলীগের পদধারী নেতা। তবে অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ছাত্রহত্যার ঘটনাগুলোর মত বুয়েটে আবরার হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেয়া বা হীমঘরে পাঠিয়ে দেয়ার সুযোগ হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার প্রতিফলন রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বহিষ্কার, ক্যাসিনো কান্ডে বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার এবং যুবলীগ নেতাদের হাতে হাতকড়া পরানোর ধারাবাহিক তৎপরতার মাঝখানে আবরার হত্যাকান্ড ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর নিষ্ঠুর অপরাধ প্রবণতা ও অপরাজনীতির পোস্টমর্টেম তুলে ধরেছে। দেশের শিক্ষাঙ্গণের এহেন বর্বরতার চর্চা, হলে হলে টর্চার সেল খুলে খুন-জখম, নির্যাতন - নিষ্ঠুরতা, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির বল্গাহীন উন্মত্ততা বন্ধের স্থায়ী ব্যবস্থা না হলে শুধুমাত্র আবরার হত্যার বিচার করেই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। গত চার দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। রক্তাক্ত সংঘাতের শিকার হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তবে অতীতে আর কখনো এভাবে হলে হলে টর্চার সেল খুলে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের বৈরীতার নজির তুলে ধরে ফেইজুবকে দেশের পক্ষে স্টাটাস লেখার কারণে বুয়েটে সহপাঠিদের নির্যাতনে আবরারের মৃত্যু না হলে এ বিষয়টি হয়তো আরো বহুদিন লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যেত। তিন ধাপে নির্যাতন করে আবরার ফাহাদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফা নির্যাতনের পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই হয়তো সে বেঁচে যেত। সে ক্ষেত্রে তাদের নরকপুরিতে হয়তো আরো বহু শিক্ষার্থীকে এভাবেই নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এখন কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের নির্যাতন, সন্ত্রাস-অপকর্মের উন্মত্ততা ও টর্চার সেল বন্ধ হবে? দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহুমতের রাজনৈতিক সহাবস্থান, নির্বাচিত ছাত্র সংসদ না থাকায় কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়ায় সেখানে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অস্ত্র ও মাদকের অবাধ ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আবরার হত্যার পর প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ নির্দেশ বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনো তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

যুবলীগ নেতাদের অফিস থেকে শুরু করে বুয়েট ছাত্রলীগের অভিযুক্তদের কক্ষ ও টর্চার সেল পর্যন্ত প্রতিটি স্পটে মাদকের মজুদ ও মাদক ব্যবহারের আলামত পাওয়া গেছে। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির অবৈধ অর্থ, মদ, জুয়া ও অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে দেশের একেকটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যেন অন্ধকার অপরাধ জগতে পরিনত হয়েছে। সেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্সিপ্যাল বা উপাচার্যরা উন্নয়ন কর্মকান্ডের বরাদ্দ থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের ম্যানেজ করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের কোটি টাকার ঈদ সালামি গ্রহণের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের দুই শীর্ষনেতাকে বহিষ্কার করেছেন। এর আগের কমিটির ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের সম্পদের বিবরণ গত কয়েক সপ্তাহে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী এই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এখন যুক্তরাজ্যে চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। দেশের লাখ লাখ তরুন-যুবক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বঞ্চনা-নির্যাতন সহ্য করে উচ্চশিক্ষা নেয়ার পর চাকরির অভাবে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে অথবা যেনতেন প্রকারে ভিসা যোগাড় করে কিংবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সে সময়ে আরেক শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছাত্রজীবনেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও মাদক ব্যবসাকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে বিলাসী জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ রুদ্ধ করার পাশাপাশি অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ঐতিহ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে ধরার মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সূতিকাগার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে মাদকের ব্যবহার বন্ধ না হলে ক্যাম্পাস ও হলে সন্ত্রাস-নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের ঘটনা বন্ধ করা অসম্ভব। সীমান্ত পথে মাদক চোরাচালান এবং সারাদেশে মাদকের অবাধ বিপনণ বন্ধ না করে শুধুমাত্র মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়েই যুব সমাজের অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা বন্ধ হবে না। আবরার হত্যায় অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হলেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা অসম্ভব যদি বুয়েটসহ উচ্চশিক্ষাঙ্গণে তথাকথিত র‌্যাগিং কালচার কঠোরভাবে বন্ধ করা না হয়। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও এসব শিক্ষাঙ্গণে র‌্যাগ কালচার খুব বেশি দিনের নয়। তবে এই কালচারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের পেছনে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নেতৃত্ব, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকের অবাধ ব্যবহার ও বাণিজ্য, অবৈধ অস্ত্র ও পেশিশক্তির বেপরোয়া ব্যবহার রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনীহা ও ব্যর্থতাই দায়ী। আবরার হত্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুয়েটে র‌্যাগিংয়ের নামে নবাগত শিক্ষার্থীদের উপর সিনিয়র বড়ভাই দের নির্যাতনের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা যেন প্রাচীন গ্রীসের এরিনা বা মল্লযুদ্ধের নির্মম মঞ্চকেও হার মানায়। তৎকালীন রাজারা ক্রীতদাসদের মধ্য থেকে বাছাই করা যোদ্ধাদের দিয়ে প্রতিযোগিতা করাতো, সেখানে একজনের হাতে আরেকজনের মৃত্যু হলে সেই দৃশ্য উপভোগ করত রাজারা। র‌্যাগিংয়ের নামে নিজ ব্যাচমেট পরস্পরকে মারধর করা, অশ্লীল ভিডিও চালিয়ে অনৈতিক কর্মকান্ড করতে বাধ্য করা, নানা অজুহাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো, অশ্রাব্য গালাগাল করার মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশেষায়িত শিক্ষাজীবনের শুরুতেই একটি মনস্তাত্তি¡ক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দেয়ার এই কালচার জাতির শ্রেষ্ঠ সম্ভাবনাময় সন্তানদের শিক্ষা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী প্রতিভাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। আবরার মরে গিয়ে সেই কুৎসিৎ কালচার ও তথাকথিত বড়ভাইদের বেপরোয়া আচরণ ও নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়া বুয়েটসহ দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গণের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর গোপণ কান্না ও আর্তনাদের কাহিনী পেন্ডোরার বাক্সের মত উলঙ্গ হয়ে গেছে। এ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে এখন রাষ্ট্রকেই যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

কাশ্মীর উপত্যকায় পাক-ভারত উত্তেজনার প্রসঙ্গ বাদ দিলে উপমহাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো ঘটনা না থাকলেও এই মাসে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত সফর শেষ করে দেশে ফেরার পরদিন সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুইদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বেইজিং সফর করেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের দুইদিন আগে ইমরান খানের বেইজিং সফরকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এবারো শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারতের তরফ থেকে এই গুরুত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরের শুরুতে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হননি। এমনকি কোনো সিনিয়র মন্ত্রীকেও সে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন মহিলা ও শিশুকল্যান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের বিবেচনায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশই হচ্ছে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এমনিতে গত এক দশকে ইউরোপ-আমেরিকা, জাপান বা কোরিয়াকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রেমিটেন্স আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর অথবা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরে একেকবার দিল্লীর জন্য অভাবনীয় প্রাপ্তিযোগ ঘটে থাকে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে বিষয়ে সবিস্তার আলোচনা নিস্প্রয়োজন। এতকিছুর পরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্বহীনভাবে অভ্যর্থনা আমাদের নাগরিক সমাজকে ব্যথিত করে। ভারতের বৈরী প্রতিবেশি চীনা প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানাতে নরেন্দ্র মোদি তামিল নাড়–র মামাল্লাপুরাম বিমানবন্দর ও পর্যটনকেন্দ্রে ছুঁটে গিয়েছিলেন। সেখানে দুইদিন ধরে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে চীনা প্রেসিডেন্টের মনোরঞ্জনে নরেন্দ্র মোদিকে সার্বক্ষনিক সঙ্গী হিসেবে দেখা গেছে। অথচ চীনা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ভারতের অর্থনৈতিক বা কৌশলগত প্রাপ্তি প্রায় শূণ্য। ইতিপূর্বে ২০১৪ সালের ভারত সফরের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব দিলেও এবার তেমন কোনো ঘোষণা শোনা যায়নি। উপরন্তু ভারত সফরের আগে পাকিস্তানকে ৩০০ অত্যাধুনিক ট্যাংক দেয়ার ঘোষণার কথা জানা যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরে যে সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার মধ্যে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের সুযোগ, বঙ্গোপসাগরে সার্ভেইলেন্স রাডার স্থাপন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ এবং বাংলাদেশ থেকে এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে ভারতে এলএনজি গ্যাস সরবরাহের সুযোগ সাম্প্রতিক সময়ের যে কোনো দেশের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে। এখানে বাংলাদেশের দৃশ্যমান কোনো প্রাপ্তি নেই। মেধাবী বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ এ বিষয়ে নাগরিক হিসেবে ফেইজবুকে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল যৌক্তিক উপস্থাপনা এবং পরিমিত ভাষায়। আবরারের বেশ কয়েকটি পোস্ট ফেইজবুকে ভাইরাল হয়। বুয়েট ছাত্র লীগের মদ্যপ মাথামোটা নেতারা আবরারকে শিবির কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করতে এসব স্টাটাসকে প্রতিক হিসেবে বিবেচনা করেছে। আবরারকে পিটিয়ে হত্যাকারীরা মাদকাসক্ত ছিল। গ্রেফতার হওয়া কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তা স্বীকার করেছে। শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস- চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, র‌্যাগিং নিষ্ঠুরতা বন্ধ এবং সহাবস্থানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই মাদক বন্ধ করতে হবে। এমনকি শিক্ষাঙ্গণগুলোকে ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভেতর থেকে রাজনৈতিক সহাবস্থান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জাতীয় স্বার্থের নিরীখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ডিবেট ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তোলার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক হীন দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি দিয়ে দেশে ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, পরিবর্তনের পক্ষে আবরারের হত্যাকান্ড সেই সত্যই সামনে নিয়ে এসেছে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন