শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ওষুধশিল্পের সম্ভাবনা এবং বেক্সিমকোর অগ্রযাত্রা

প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশের বেসরকারী খাতের বৃহত্তম কনগ্লোমারিট বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম কোম্পানী বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবার কুয়েতে ওষুধ রফতানী শুরু করেছে। গত বৃহস্পতিবার বেক্সিমকো ফার্মার টঙ্গিস্থ কারখানা প্রাঙ্গণে ঢাকাস্থ কুয়েতি রাষ্ট্রদূত এবং বেক্সিমকো গ্রুপের কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে কুয়েতে ওষুধ রফতানীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বেক্সিমকো ফার্মা ইতিমধ্যে বিশ্বের অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রে ওষুধ রফতানী করলেও জিসিসি বা গাল্ফ অঞ্চলের কোন দেশে ওষুধ রফতানীর ঘটনা এটাই সম্ভবত প্রথম। গাল্ফ অঞ্চলে ৯০০ কোটি ডলারের ওষুধের বাজার রয়েছে। গত অর্থবছরে বেক্সিমকো ফার্মা বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানী করে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় করেছে বলে জানা যায়। আগামী ৫ বছরে কোম্পানীটি ওষুধ রফতানী আয় ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার আশাবাদ প্রকাশ করেছে। কুয়েতে ওষুধ রফতানীর মধ্য দিয়ে গাল্ফ দেশগুলোতে বাংলাদেশী ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীগুলোর ওষুধ রফতানীর পথ সুগম হলো। যেখানে শুধুমাত্র কুয়েতেই ১০০ কোটি ডলারের বাজার রয়েছে, সেখানে শতাধিক দেশে ওষুধ রফতানীর ধারাবাহিকতায় আগামী ৫ বছরে বিশ্ববাজার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেক্সিমকোর জন্য অসম্ভব নয়। পাট, চা, চামড়া ও গার্মেন্টস খাতসহ দেশের ট্রাডিশনাল রফতানী বাণিজ্যে ঋণাত্মক প্রবণতা দেখা গেলেও ওষুধে প্রবৃদ্ধি ক্রমেই বাড়ছে। গত অর্থ বছরে ওষুধশিল্পে রফতানী প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৮ ভাগের বেশী ছিল।
ওষুধশিল্পের হাত ধরে দেশের রফতানী বাণিজ্য এক সোনালী সম্ভাবনার দিকে যাত্রা অব্যাহত  রেখেছে। ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত জটিলতা কাটিয়ে বাংলাদেশসহ এলডিসিভুক্ত দেশগুলো আরো ১৭ বছরের জন্য বিশেষ ছাড় পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দীর্ঘ দরকষাকষির পর গত বছর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্ব আইনের বাধ্যবাধকতা আরো ১৭ বছরের জন্য শিথিল করেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওষুধশিল্পকে বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ামকে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ফরাসউদ্দিন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনীয় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং ইনসেন্টিভ নিশ্চিত করা হলে দেশের ওষুধ কোম্পানীগুলো শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ১০ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ রফতানী করতে সক্ষম হতে পারে। গার্মেন্টস শিল্পের মত বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানীগুলোও তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ উৎপাদন ও রফতানীতে সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এ ক্ষেত্রে অব্যাহভাবে অন্যতম পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ফার্মাসিউটিক্যাল ছাড়াও টেক্সটাইল, রিয়েল এস্টেট, আইটি, মিডিয়া, এনার্জি, সিরামিকস এবং ফিনানসিয়াল সার্ভিসসহ অনেক ক্ষেত্রেই বেক্সিমকো দেশের শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে। ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশী বাজার মূলধন নিয়ে বেক্সিমকো দেশের পুঁজি বাজারের অন্যতম বড় শক্তি হিসেবে তার সুদৃঢ় অবস্থান বজায় রেখে চলেছে।
গত চার দশকে বাংলাদেশ ওষুধশিল্পে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। অভ্যন্তরীণ ওষুধের বাজারের চাহিদার প্রায় পুরোটাই দেশীয় ওষুধ কোম্পানীগুলো পূরণ করছে, যার বাজারমূল্য বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশী। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমন্বয়ে বিশ্বমানের ওষুধ উৎপাদনে দেশের ওষুধ কোম্পানীগুলোতে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানা যায়। পাশাপাশি অনেক মানহীন ও অননুমোদিত কোম্পানীও নানা ধরনের ভেজাল ও মানহীন ওষুধ উৎপাদন করে দেশের ওষুধের বাজারকে কলুষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের দায়-দায়িত্বে ব্যর্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বেক্সিমকোসহ কিছু সংখ্যক বিশ্বমানের ওষুধ কোম্পানী বিদেশে ওষুধ রফতানীর মাধ্যমে এ খাতকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হলেও দেশীয় বাজারে মানহীন, অননুমোদিত দেশী-বিদেশী ওষুধে সয়লাব হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা দুঃখজনক। আমাদের ওষুধশিল্পের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা বাদ দিলেও দেশের স্বাস্থ্যসেবা এবং শত বিলিয়ন টাকার বাজারের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে এ খাতের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও মানহীনতা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ওষুধশিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন এবং আমদানীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনগত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গার্মেন্টস শিল্পের মত বাংলাদেশের ওষুধও বিশ্ববাজারে আরো ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে প্রচলিত শিল্পখাতের রফতানী বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে, সেখানে ওষুধশিল্প রফতানী প্রবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। বেক্সিমকোসহ নেতৃস্থানীয় ওষুধ কোম্পানীগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ওষুধের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় খাত হয়ে উঠবে। এই সম্ভাবনা এখন আমাদের ওষুধশিল্প উদ্যোক্তাদের হাতের মুঠোয়। তবে তা বাস্তবে রূপ দিতে একটি সময়োপযোগী সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। একটি মাত্র জুটমিল এবং আমদানী-রফতানীর সীমিত ব্যবসায় উদ্যোগ থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ দেশের বৃহত্তম বেসরকারী কোম্পানীতে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে, তা অনুকরণীয়। দেশের জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতে সুনির্দিষ্ট অবদানের মাধ্যমে বেক্সিমকো জাতির সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। আমরা তার উত্তরোত্তর অগ্রগতি ও প্রসার কামনা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন