দেশজুড়ে সাত দিনব্যাপী পুলিশের জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ গণগ্রেফতারের শিকার হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা গেছে। এ অভিযানে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধি ছাড়া আর কী লাভ হয়েছে এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে, তা নিয়ে সচেতন মহল প্রশ্ন তুলছে। অবশ্য শুরু থেকেই বিশ্লেষকরা এ অভিযান নিয়ে বিভিন্ন সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করে আসছিলেন। কেউ কেউ এই অভিযানকে ঈদের আগে পুলিশকে গ্রেফতার বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অভিযোগ করেছে, তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালানো এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা এবং গ্রেফতার বাণিজ্যের লক্ষ্যেই এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দলটি দাবি করেছে। সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায়, সচেতন মহলের অভিমত এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভিযোগ অস্বীকার্য হয়। পুলিশ এমনই অভিযান চালায় যে পাইকারি হারে সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হলেও তাদের অভিযানের টার্গেট যে জঙ্গি তা অতি সামান্যই ধরা পড়েছে। যদিও পুলিশ গণগ্রেফতারের মাঝে যাদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। এই বিশেষ অভিযানে গণগ্রেফতারের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হচ্ছে, এতে মানবিক বিপর্যয়ের একটি দিক ফুটে উঠেছে। গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকার মানুষদের স্বজনদের অনেকেই তাদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে স্বজনকে ছাড়িয়েছে। যারা ছাড়াতে পারেনি, তাদের স্বজনকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে। সেখানেও আরেক অমানবিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় গাঁদাগাঁদি করে থাকতে হচ্ছে। কারাগারে গিয়েও কারাগারের ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। নতুন বন্দীরা পুরনো বন্দীদের কাছে উৎপাতের কারণ। এতে কারাগারগুলোতে বন্দীদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে কারাগার রয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ১৩টি। সরকারি হিসাবে সব কারাগারের বন্দী ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ৭০০। বাস্তবে বন্দীর সংখ্যা যে কোথাও কোথাও দ্বিগুণের বেশি, তা বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। কারাগারে অতিরিক্ত বন্দীর এ চাপ বৃদ্ধি বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। বিশেষ করে বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন এবং নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের কারণে কারাগারগুলোতে স্বাভাবিকের তুলনায় বন্দীর সংখ্যা বেশ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। যে হারে গ্রেফতার হয়, তার চেয়ে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার হার অনেক কম। এমনকি বিনা অপরাধে শত শত বন্দী কারাগারে রয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফলে কারাগারগুলোতে স্থান সংকুলান করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে বন্দীদের মধ্যে অসন্তোষও দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে যখন বিশেষ অভিযান শুরু হয়, তখন কারাগারগুলোর অবস্থা কী হয়, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই জানেন, কারাগার কোনো সুখের জায়গা নয়। তবে সংশোধনাগার হিসেবে কারাকর্তৃপক্ষকে অনেক বেশি মানবিক হয়ে উঠতে হয়। বন্দীদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দেয়ার বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। দুঃখের বিষয়, গত এক সপ্তাহ ধরে চলা অভিযানে যেভাবে সাধারণ ও নিরীহ মানুষ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তাতে কারাগারগুলোতে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কোনো কারাগারে ধারণক্ষমতার তিন গুণ, চার গুণ বন্দীকে জায়গা দিতে হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান গত বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করতে গিয়ে বলেন, কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা রয়েছে ২০০৬ জনের। অথচ সেখানে বন্দী রয়েছে ৭ হাজার ৩২৮ জন। ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণের বেশি বন্দী রয়েছে। এ পরিবেশ অমানবিক। বলা বাহুল্য, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বন্দীসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে, না হয় রাজনৈতিক দমন-পীড়ন অতিমাত্রায় চলছে। এ দুটো যদি স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থাকত, তাহলে কারাগারগুলোতে এই অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ থাকত না। বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই বলা হচ্ছে, তার দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি পদে দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার করে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে। সরকার পুরো দেশটাকে কারাগারে পরিণত করেছে। বিএনপির এ বক্তব্য রাজনৈতিক বলে ধরলেও বর্তমান বাস্তবতার সাথে যে এর যথেষ্ট মিল রয়েছে, তা কারাগারগুলোর অমানবিক ও দুঃসহ চিত্র থেকেই বোঝা যায়। কোনো সভ্য দেশে এমন চিত্র দেখা না।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বা দাগি সন্ত্রাসীদের ধরতে গিয়ে পুলিশের অভিযানে যদি সাধারণ মানুষকে হয়রানির শিকার ও দুর্বিপাকে পড়তে হয়, তাহলে এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। জনগণের নিরাপত্তার কথা বলে তাদেরই জিম্মি করে ফেলা কোন ধরনের আইনশৃঙ্খলা উন্নতির পদক্ষেপ, তা বোধগম্য নয়। জনগণ যখনই শোনে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হবে, তখন তারাই সবার আগে আঁতকে ওঠে। কারণ তারা ভাল করে জানে, যাদের উদ্দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে, তাদের টিকিটিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্পর্শ করতে পারবে না। তারা জানে, ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাসী বা দাগি আসামী ধরার নজির বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে কেবল সাধারণ মানুষের হয়রানি এবং পুলিশের একটি শ্রেণীর লাভবান হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় না। এবারের সাঁড়াশি অভিযানেও তারই পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। হাজার হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশের একটি শ্রেণী এন্তার বাণিজ্যের মাধ্যমে ঈদের আগে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। যারা পুলিশের ডিমান্ড পূরণ করতে পেরেছে তারা ছাড়া পেয়েছে, যারা পারেনি তারা জেলে ঢুকেছে। সৃষ্ট হয়েছে অমানবিক পরিস্থিতির। আমরা আশা করব, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। ঈদের আগেই কারাগারগুলোর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। যেসব নিরপরাধ সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হয়েছে, অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে এটা ভাবতে হবে, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করাতে কৃতিত্বের কিছু নেই। সাঁড়াশি অভিযানের নামে যে অনিয়ম হয়েছে, তাতে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হওয়া ছাড়া কোনো লাভ হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন