শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নিম্নমুখী শিক্ষামান, জাতির ভবিষ্যৎ কি?

জহির চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ৫টি মানদন্ড বিশ্লেষণ করে বিশে^র ৯২টি দেশের বাছাই করা ১৩৯৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং করেছ। ৫টি মানদন্ডের মধ্যে ছিল শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এ খাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা। র‌্যাংকিং প্রতিবেদনটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। তাতে জানা গেছে, বিশে^র সেরা ১৩৯৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের এক মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়েছে হাজারের পরে। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ২০১৬ সাল থেকে বৈশি^ক বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর চার বছরের বৈশি^ক বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাকিং প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ চার বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৪০০ ধাপ নেমেছে। ৯২টি দেশের বাছাই করা ১৩৯৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ৩০০ থেকে হাজারের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ৩৬টি এবং শীর্ষ হাজারের মধ্যে পাকিস্তানের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে সাময়িকীটি এশিয়ার সেরা ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছিল। ওই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ^বিদ্যালয়ের স্থান হয়নি। এশিয়ার সেরা ৪১৭ বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের তুলনায় অনগ্রসর নেপালের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার করুণ দশা আন্তর্জাতিক বা বৈশি^ক বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং প্রতিবেদন প্রকাশ হলেই দৃশ্যমান হয়। স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েবমেট্রিক্স’-এর ওয়েবভিত্তিক কর্মকান্ডের ভিত্তিতে ২০১২ সালে করা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান বিশ্বের দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছিল না। ওই র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ২৩৯৭তম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৭১৪তম স্থানে ছিল। স্পেনের কনসেহো সুপেরিয়র দো ইনভেসতিগাসিওনস সাইন্তিফিকাস (সিআইসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন সাইবার মেট্রিক্স ল্যাব ২০০৯ সালে ইলেকট্রনিক পাবলিকেসন্স, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং আন্তজার্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মকান্ডের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের ৬ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে একটি তালিকা করেছিল। ওই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৪৯২২তম।

শুধু উচ্চ শিক্ষার নয়, সকল স্তরের শিক্ষার মানই এখন তলানিতে। বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮: লানিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে। তাও এদের পড়ার মান খারাপ। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ কোনোরকম অংকে পাশ করতে পারে। বাকি ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই পাঠ্য বইয়ের গণিত বোঝে না। ২০১৪ সালে বিশ^ব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভর্তির হার বাড়লেও কমছে শিক্ষার মান। সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ৭৫ শতাংশ বাংলাতেই দক্ষ নয়। ইংরেজি ও গণিতে অবস্থা আরো করুণ। একই বছর আন্তর্জতিক গবেষণা সংস্থা ‘রুম টু রিড’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পাস করা শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা বাংলা পঠন দক্ষতা সন্তোষজনক নয়। দেশের শিক্ষার মান অবনতি শিক্ষার্থীদের বিদ্যার দৌড় দেখলেও বুঝা যায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮০ ভাগ বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হওয়ার নজির চোখের সামনেই রয়েছে। ২০১৪ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ কি ছেলে খেলা’ শিরোনামের এক উপসম্পাদকীয়তে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘আজকাল বিএ, এম এ পাস ছেলেমেয়ে আগেরকার দিনের ফাইভ-সিক্সের জ্ঞানও রাখে না। বছর পাঁচেক আগে দেখতে শুনতে দারুণ এক ছেলে চাকরি চাইতে এসেছিল। তখন চাকরি দেয়ার ক্ষমতা ছিল, দিতেও পারতাম। তাকে শুধু বলেছিলাম, সাদা একটি কাগজে লেখ, আমি এখন জনাব কাদের সিদ্দিকীর সামনে। সকালে বাড়ি থেকে আসতে রাস্তায় কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি। সামনে বসা ছেলেটি ইংরেজি তো দূরের কথা, বাংলা লিখতেও চারটি ভুল করেছিল। দাড়ি, কমা সব কয়টি ভুল। ছেলেটি এমএ পাস, ভালো ফল করেছে। তার পরও এ অবস্থা।’ বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে শিক্ষকতার জন্য মনোনীত হয়েছেন এমন ৩০ জনের সাথে ২০১৪ সালে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। শিক্ষা সচিব বিসিএস উত্তীর্ণদের ‘কৃচ্ছ্র’ শব্দের বানান লিখে দেখাতে বললে মাত্র ২ জন সঠিকভাবে ‘কৃচ্ছ্র’ শব্দের বানান লিখতে সক্ষম হন। সকল স্তরের শিক্ষার মান এখন অবনতির দিকে।

দুর্ভাগ্যজনক যে, নিম্নমানের শিক্ষা দায়িত্বশীলদের ভাবাচ্ছে বলে মনে হয় না। চোখের সামনে নিম্নমানের শিক্ষায় বেড়ে উঠছে প্রজন্ম। শিক্ষাখাতে ব্যয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা-জৌলুস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা, সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে; কমেছে শিক্ষারমান। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর নির্বাচিত বিশে^র সেরা ১৩৯৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ পাকিস্তানের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়েছে; পাকিস্তানের কায়েদ-ই আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়েছে সেরা পাঁচশ’র মধ্যে। অথচ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাঁই এক হাজারের মধ্যেও হয়নি। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ বিদেশী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শূন্য নম্বর দিয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে শূন্য পাওয়ার অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থী নেই, থাকলেও উল্লেখযোগ্য নয়। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী দেখা যেত। বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল নামে ছাত্রাবাস পর্যন্ত রয়েছে। শিক্ষার মান অবনতি কেন হচ্ছে খতিয়ে দেখা দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ, শিক্ষক নিয়োগ-পদায়নে দলীয় পরিচয় প্রাধান্য দেয়া, শিক্ষকদের দলবাজি-বাণিজ্যিক মানসিকতা, শিক্ষাখাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, বরাদ্দের বড় অংশ শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় না করে দুর্নীতি লুটপাটের জন্য অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় শিক্ষারমান তলানিতে নেয়ার জন্য বহুলাংশে দায়ী তা অস্বীকার করা যাবে না। শুনতে খারপ লাগলেও এটাই বাস্তবতা যে, মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব না দিয়ে দেশকে নিম্নমানের শিক্ষায় বেড়ে উঠা প্রজন্মের দেশ বানানো হচ্ছে।

নিম্নমানের শিক্ষায় বেড়ে উঠা প্রজন্ম কার্যত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। নিম্নমানের শিক্ষায় বেড়ে উঠা প্রজন্ম প্রতিযোগিতামূলক বিশে^ বাতিল মালের মতোই পরিত্যাক্ত। শিক্ষার মান অবনতি অস্বীকার বা ঠুনকো অজুহাত খাড়া করে দায় এড়ানোর চেষ্টা আর না করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। শিক্ষার মানোন্নয়নে সময়ক্ষেপণ অপূরণীয় ক্ষতি করছে। মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। জাতীয় স্বার্থে আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষার জন্য যা করণীয় তাই করতে হবে। অর্থ ও দক্ষ লোকবলের সংকট আছে মেনে নিলেও, এ সংকটকে মানসম্মত শিক্ষার প্রতিবন্ধক দেখিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ খাতের ব্যয় বন্ধ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অনেকটাই সংকুলান করা যায়। মানসম্মত শিক্ষার জন্য দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংকট থাকলে তা পূরণ করাও খুব একটা কঠিন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বাংলাদেশি শিক্ষকতা করছেন। সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ওইসব শিক্ষকদের দেশে আনার উদ্যাগ নিলে অনেকেই আসবেন। কিছুটা সময় লাগলেও শিক্ষকতা করছেন এমনদের মধ্যে যারা মেধাবী তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শিক্ষক তৈরি সম্ভব। অর্থ ও দক্ষ লোকবল সংকট অসমাধানযোগ্য সমস্যা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ বন্ধ করা হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান অরাজকতার অবসান ঘটবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উৎকর্ষ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে। চেষ্টা থাকলে সীমিত অর্থ সম্পদ দিয়েও শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব। নিম্নমানের শিক্ষার পেছনে ব্যয়িত অর্থ প্রকারান্তরে গচ্চাই যাচ্ছে। দেশের শিক্ষারমান নিয়ে সন্তুষ্টির সুযোগ নেই। শিক্ষারমানই বলছে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। রুগ্ন শিক্ষাব্যবস্থার ফল নিম্নমানের শিক্ষা। শিক্ষারমান তলানিতে ঠেকেছে। শিক্ষারমান এ হলে জাতির ভবিষ্যত কি সে প্রশ্ন এসে যায়।
লেখক: কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন