শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মনুষ্যত্ব নির্বাসনে

ইসমাইল মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু এই মানুষই আবার কর্মের কারণে বর্তমান সময়ে সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব বলে পরিগণিত। যে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ থাকে না, তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ বলতে মানুষের ভেতর মানবীয় গুণ থাকতে হয়। মানবিক আচরণ থাকতে হয়। শুধুমাত্র মনুষ্যকূলে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে মানবিক গুণ, নৈতিকতা, সহিষ্ণুতা থাকতে হয়। চিন্তা-চেতনার বিকাশ, বিবেকবোধ, কান্ডজ্ঞান আর বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতার কারণে মহান আল্লাহ তা’আলা মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী হবে সেটাই স্বাভাবিক। মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধ না থাকলে মানুষ কখনই মানুষ নয়। কিন্তু বর্তমানে প্রাত্যহিক লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, উগ্রতা, স্বার্থপরতা, ক্রোধ প্রভৃতি কারণে মানুষের মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। এক কথায় মনুষত্ব আজ নির্বাসনে।

এই পৃথিবীতে সন্তানের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হল তার বাবা ও মা। একজন মানুষ যদি পৃথিবীর সব মানুষ কর্তৃক অবহেলিত হয় বা তার কাছে সুন্দর পৃথিবী যখন অন্ধকারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন হতাশার চাদরে আবৃত সেই মানুষের কাছে বাবা-মা আশার প্রদীপ ও নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমান সমাজে নিজ পরিবারই যেন নিরাপত্তাহীন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজ পিতা বা মাতা সন্তানকে হত্যা করছে। আজ যেন আমরা পাশবিকতার ষোলকলা পূর্ণ করছি। আমাদের মধ্যে আজ যেন মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই। আমরা আজ যে মনুষ্যত্বহীন সমাজে বাস করছি তার দায় কিন্তু আমাদেরই। আমরা দিনে দিনে আমাদের সমাজটাকে একটা চরম বর্বরতার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি।

মানুষের মনুষ্যত্ব যখন চরমভাবে লোপ পায় তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে হায়েনা। তখন সমাজে দ্রুত বেড়ে যায় অপরাধ প্রবণতা। খুন, গুম, ধর্ষণ, লুটপাট, চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং, প্রতারণা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, অপহরণ, দুর্নীতি, অরাজকতা, মিথ্যা বলা, অন্যের ক্ষতি সাধন, অন্যকে বিপদে ফেলা ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টি ইত্যাদি কাজ প্রতিনিয়তই সংঘটিত হতে থাকে।

সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভালো এবং মন্দের দ্ব›দ্ব থাকবে। আর এটাই স্বাভাবিক। সকল খারাপ বা মন্দকে পরিহার করে ভালো বা সৎ কর্মকে বেছে নেয়া, ভালো পথ অনুসরণ করা মনুষ্যত্বের অন্যতম কাজ। আদর, দয়া, মায়া, মমতা, বিনয়ী, ক্ষমা, স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা, উদারতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সততা, ধৈর্য, ত্যাগ, সহনশীলতা, সহানুভ‚তি, সৌজন্য, আদব-কায়দা, শৃঙ্খলা, কল্যাণ চিন্তা, ভালো ব্যবহার ইত্যাদি হচ্ছে একজন মানুষের মনুষ্যত্বের মূল উপাদান। সমাজে প্রতিটি মানুষের মধ্যে লোকায়িত থাকে মনুষত্ব। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সেই মনুষত্বকে লালন করার কথা। কিন্তু আজ কোথায় সেই মনুষত্ব? মারামারি-হানাহানিসহ সকল অপরাধমূলক কর্মকান্ড আজ যেন ‘ডাল-ভাত’।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই সমাজের প্রতিটি শিশু নিজের পরিবারের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে গণ্য। আজ সেই নিরাপদ স্থানটি তাসের ঘরের মতো উবে গেছে। সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার কেজাউড়া গ্রামে জন্মদাতা বাবা, চাচা, চাচাতো ভাই একটি শিশুকে বীভৎসভাবে হত্যার পর গাছে ঝুলিয়ে রাখার মতো চরম বর্বরতা দেখিয়েছে। এ ঘটনায় দেশের বিবেকবান মানুষের আত্মরাত্মা কেঁপে উঠেছে। দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষমাত্রই শিউরে উঠেছেন।

পাঁচ বছর বয়সের কোমলমতি ছোট্ট ফুটফুটে শিশু তুহিন মিয়া। শিশুটি পারিবারিক কলহের কারনে নিজের পরিবারের নিশানায় পরিণত হয়েছে। শিশু তুহিনকে বর্বরোচিত কায়দায় হত্যার ঘটনা সারাদেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার নিথর মৃতদেহ উদ্ধারের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিক তৎপর হয়ে ওঠে। সন্দেহজনক আচরণের কারণে পুলিশ আটক করে তুহিনের বাবা, চাচা, চাচাতো ভাইসহ পরিবারের আরো কয়েক সদস্যকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা ফুটফুটে শিশু তুহিন খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিনকে নিজের পরিবারই শিকার বানিয়েছে। তুহিন হত্যায় জড়িত তিনজন। তারা হলো শিশুটির জন্মদাতা বাবা আব্দুল বাছির, চাচা নাছির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। খুনিদের বর্ণনা মতে, গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় শিশু তুহিনকে কোলে করে ঘরের বাইরে বের করে আনে তার জন্মদাতা বাবা। আর যে স্থান সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ সেই বাবার কোলেই ঘুমন্ত অবস্থায় তুহিনকে ছুরি দিয়ে গলাকেটে খুন করে চাচা নাসির উদ্দিন ও চাচাতো ভাই শাহরিয়ার। তারপর শিশুটির কান ও যৌনাঙ্গ কেটে পেটে দুটি ছুরি ঢুকিয়ে তার মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখে কদম গাছের ডালে। পরে এ ঘটনার দায় স্বীকার করে সুনামগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তুহিনের বাবা ও চাচা। পুলিশ জানিয়েছে, তুহিনের হত্যাকারী বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাই আরও দুটি হত্যা মামলার পাশাপাশি আরও দুটি মামলার আসামি। পারিবারিক বিরোধ ও এক হত্যা মামলার জেরে বলি হলো তুহিন। পিতা আব্দুল বাছির প্রতিপক্ষের করা হত্যা মামলার আসামি। ওই মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের ঔরসজাত সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে মানুষ নামের অমানুষ আব্দুল বাছিরসহ তার পরিবারের সদস্যরা।

দেশে পারিবারিক বিরোধের শিকার শিশু হত্যার ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয়। প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। প্রায় সব ঘটনাতেই আসামীদের নিয়ে আসা হচ্ছে বিচারের কাটগড়ায়। বিচার হচ্ছে, তবে তাতে রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। অনেক সময় আসামীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেসব ঘটনায় বিচারের রায় হচ্ছে, সেসব রায় অনেক কালক্ষেপন করেও কার্যকর হচ্ছে না। ফলে দেশে একের পর এক শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে। তুহিন হত্যার ঘটনায় দেশের আপামর মানুষের দাবি দ্রুততম সময়ে বর্বরোচিত এ হত্যার বিচার হোক। বিচারে প্রদত্ত দন্ড দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর হোক।

মানুষের মধ্যে জাগ্রত হোক মানুষের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা। মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিষয়টি পুরোপুরি মানুষের চিন্তা চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। মানুষ একমাত্র তাদেরই বলা যায় যাদের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব জ্ঞান বলে কিছু একটা আছে। কামনা করছি আমাদের দেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, নির্যাতন, শিশু হত্যা নেমে আসুক শূন্যের কোঠায়। মানুষের বিবেক জাগ্রত হোক। প্রায় নির্বাসিত মনুষত্ব আবারো ফিরে আসুক।
লেখক : গণমাধ্যকর্মী ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন