শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সিরিয়ায় মার্কিনিদের পতন : মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দিদের নিয়ে নতুন খেলা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

সিরিয়ায় পশ্চিমা লক্ষ্য বাস্তবায়ন যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল, তখন ন্যাটো অংশীদার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদাগান সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধে উদ্বাস্তু লাখ লাখ সিরীয় ও ইরাকি পরিবারকে পুনর্বাসনের একটি চমৎকার ফর্মুলা হাজির করেছেন। মূলত কুর্দি অধ্যুসিত এলাকাকে ঘিরে এ ধরনের সেইফ জোন তৈরীর পেছনে তুর্কি প্রেসিডেন্টের মূল এজেন্ডা ছিল সম্ভবত তার দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি সম্প্রদায়ভুক্ত সিরীয় কুর্দি বাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তিকে শায়েস্তা করা। রাশিয়া ও ইরানের হস্তক্ষেপে সিরিয়া যুদ্ধ থেকে মার্কিনীরা যখন পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজছে, ঠিক তখন একটি ভিন্নমাত্রিক রণকৌশল হিসেবে এরদোগানের কুর্দি নির্মূল অভিযানে নিরব সমর্থন দিয়ে যুদ্ধমঞ্চ থেকে পালিয়ে গিয়ে মার্কিন বাহিনী নিজেদের মুখরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত ৯ অক্টোবর থেকে তুরস্ক সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তুরস্ক সীমান্তবর্তি এলাকায় প্রস্তাবিত একটি সেইফজোন গড়ে তুলতে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। হামলায় কুর্দিদের পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত মার্কিন সেনারাও চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অবশেষে ৮ দিনের মাথায় ১৭ অক্টোবর মার্কিন মধ্যস্থতায় তুরস্ক, সিরিয়া এবং কুর্দি বাহিনীর মধ্যে ৫দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহিত হয়। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দিরা এতদিন মার্কিনীদের সহায়তা নিয়ে এ অঞ্চলটি দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর ধরে সিরীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজেদের স্বাধীন এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রীন সিগন্যাল পাওয়ার পর কুর্দি এলাকায় তুর্কি বিমান হামলায় সেখানে নির্বিচার হত্যাকান্ড দেখে আতঙ্কিত কুর্দিরা অনেকটা আচমকা ও অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের আরেক জাতশত্রæ সিরীয় সরকারী বাহিনীর সাথে আঁতাত করতে বাধ্য হয়। এর ফলে শুরু থেকেই হাতছাড়া হওয়া কুর্দি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলটি আবার সিরীয় সরকারী বাহিনীর দখলে চলে যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটিতে সিরীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় জায়নবাদি-পশ্চিমা এজেন্ডা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখানে তুরস্কের সেইফ জোন বা কুর্দি নির্মূল অভিযান নিয়ে এক প্রকার ধোঁয়াশা ও জটিলতা দেখা দিলেও সিরিয়া থেকে মার্কিনীদের অকষ্মাৎ পলায়ন এবং সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর জন্য সবচেয়ে দূরূহতম এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সিরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি এবং রাশিয়া, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কের সমঝোতার বিজয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক পেপে এস্কোবার লিখেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সিআইএ’র জন্য আরেকটি বড় পরাজয় ঘটেছে সিরিয়ায়। যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে তুরস্কের উচ্চাভিলাষি এজেন্ডা বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেও তুর্কি যুদ্ধবিমানগুলোকে তাড়িয়ে দিতে রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলো সক্রিয় থাকায় সেখানে বড় ধরনের একপাক্ষিক ডিজাস্টার অনেকটাই রোধ করা গেছে। তবে সেখানে ইতিমধ্যেই কুর্দিরা তুর্কি বাহিনীর হাতে একটি বেপরোয়া গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হয়েছে। এরপরও কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে সব পক্ষের জন্য উইন-উইন, উইন-উইন অবস্থা বলে মনে করছেন। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তুরস্কের বিমান হামলা শুরুর পর সেখানে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা পরি-মরি করে পালিয়ে যেতে থাকে। একজন টিভি সাংবাদিক তার ভিডিও রিপোর্টে দেখিয়েছেন, টেবিলে খাবার ফেলে রেখেই পালিয়ে বেঁচেছে মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা। কয়েকদিন যুদ্ধের পর ইতিমধ্যে কুর্দি, রাশিয়া, তুরস্ক, সিরিয়াসহ আঞ্চলিক পক্ষগুলো একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। যদিও পরের দিন থেকে সব পক্ষই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান কুর্দি বাহিনীর উপর যে বেপরোয়া বিমান হামলা শুরু করেছে তাতে এতদিনের মার্কিন মিত্র কুর্দিদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। এরদোগানের এমন কঠোর অবস্থানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি এক টুইট বার্তার এরদোগানকে ‘টাফ গাই’ বলে অভিহিত করে প্রকারান্তরে তার সমর্থনই ব্যক্ত করেছেন। তবে তুর্কি প্রেসিডেন্টের এই ভ‚মিকা বাশার আল আসাদের বাহিনীর জন্য শাপে বর হয়েছে। এতদিনের হাতছাড়া সিরীয় ভূ খন্ড সরকারি বাহিনীর হাতে পুনর্দখল হয়ে সেখানে সিরীয় পতাকা উড্ডীন হয়েছে। সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জের পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হওয়া পশ্চিমা প্রক্সি ওয়ারের ৮ বছরের মাথায় এসে মার্কিন বাহিনী ও তাদের সমর্থনপুষ্ট বাহিনীগুলোর চরম পরাজয় ও পলায়নরত অবস্থাকে সেখানে মার্কিনীদের পরাজয়ের দৃশ্যমানতা বলেই পরিগণিত হচ্ছে। সিরিয়ার কুর্দি এবং ন্যাটো মিত্র মার্কিনীদের প্রতি তুর্কি বাহিনী ‘টাফ’হলেও তাদের অগ্রযাত্রা থামাতে রাশিয়ান বাহিনীর পাল্টা পদক্ষেপকে তারা সমীহ না করে পারছে না। মার্কিন মধ্যস্থতায় ৫দিনের যুদ্ধবিরতির পেছনের কারণ হয়তো মার্কিন সেনাসদস্যদের নিরাপদে সের যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি। তবে ৫দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর কি হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এদোগান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে দেখা করে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন। সেখানে বনিবনা না হলে তার মতো করে ব্যবস্থা নিবেন এবং কুর্দিদের মাথা গুঁড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। তবে যা হবার তা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কুর্দি এবং সিরিয়ার সরকারি বাহিনী একযোগে কাজ করছে এবং কুর্দিদের হামলায় তুর্কি সেনাদের হতাহতেরও খবর পাওয়া গেছে। কুর্দি ওয়াইপিজি বাহিনী (এসডিএফ)সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের সাথে একীভ‚ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে, কুর্দিদের নির্মূল করার এরদোগানের তর্জন গর্জন এখন অসার হয়ে পড়তে বাধ্য। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে শত শত মার্কিন সেনা সদস্য ও সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়ার পর ভ্যাকুয়াম তৈরী হওয়ায় তা থেকে তুর্কি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও রাশিয়ান ভ‚মিকার কারণে তার সুফল সিরিয়ার হাতেই গেছে। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে মার্কিন সেনাদের আপাতত ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলের ঘাটিগুলোতে নেয়া হলেও ইরাকে ইরানের শক্তিশালী অবস্থান থাকায় সেখানে মার্কিন বাহিনীর অবস্থান নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে এক প্রকার অস্বস্তি ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ রয়েছে। এখন সিরিয়ার সাথে কুর্দি বাহিনীর সমঝোতা এবং রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরানের যৌথ পরিকল্পনা তুরস্কের জন্য এক জটিল পরিস্থিতি তৈরী করেছে। সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জের লক্ষ্যে বিদ্রোহী, আইএস ও প্রক্সি বাহিনীর যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আঞ্চলিক পরাশক্তি তুরস্ককে বিভ্রান্তিকর ভূমিকায় দেখা গেছে। দামেস্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিজিম পরিবর্তন পরিকল্পনার সাথে তুরস্কের স্বার্থের সরাসরি যোগসাজশ না থাকলেও গত ৮ বছরে বিভিন্ন সময়ে এরদোগানকে ‘বাশার আল আসাদকে সরে যেতে হবে’ বলতে শোনা গেছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ইরান ও সিরিয়ার আসাদ সরকারের সাথে তরস্ককে একটি সমঝোতায় নিয়ে আসার ক‚টনৈতিক সাফল্যই সিরিয়া যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কুর্দিদের নিয়ে এরদোগান এবং তুরস্কের একেপি দলের নেতৃত্ব যে অশ্বস্তি বোধ করছে তা দূর করার পদক্ষেপও আঞ্চলিক পক্ষগুলোকে নিতে হবে।

এরদোগানের প্রশাসন সীমান্তবর্তী সিরিয়ার ওয়াইপিজি কে তুরস্কে নিষিদ্ধ ঘোষিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টির(পিকেকে)র শাখা হিসেবে গণ্য করে আসছে। এটি তুরস্কের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়। এ ধরনের রাজনৈতিক এজেন্ডা সামনে রেখে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা কোনো দায়িত্বশীল আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে বেমানান। আলেপ্পো, রাক্কা থেকে মার্কিন বাহিনী সরে যাওয়ার পর কুর্দি বাহিনীর স্থলে এসডিএফ’র অবস্থানগ্রহণ যে এতটা সহজ হবে তা আগে কেউই ভাবেনি। এই বাস্তবতাকে মেনে নেয়াই এই মুহূর্তে তুরস্কের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে। তুর্কি সীমান্তে ডি-মিলিটারাইজড সেইফ জোন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা ভাবনার অবকাশ আছে। বেপরোয়া নির্বিচার বিমান হামলা ও গোলাগুলি চালিয়ে এলাকা খালি করে নিরাপদ জোন প্রতিষ্ঠার তুর্কি প্রয়াস অন্য পক্ষগুলোর অনাস্থার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কুর্দিদের সম্পর্কে তুরস্কের যে কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। সে ধরনের পরিস্থিতিকে পুরনো শত্রুরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, মার্কিন বাহিনী সিরিয়া থেকে সরে গেলেও তারা সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে নাকচ করতেই বেশি আগ্রহী। সিরিয়া পরিস্থিতি সামনে রেখে পম্পেও ইসরাইলে ছুটে এসেছেন। সেখানে নেতানিয়াহুর সাথে গোপণ আলোচনাশেষে গণমাধ্যমের মুখোমুখি পম্পেও বলেছেন, সিরিয়ায় অভিযান চালানোর অধিকার ইসরাইলের আছে। মার্কিন বাহিনী সিরিয়া-তুরস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে সরে গেলেও তারা সিরিয়ার উপর কড়া নজর রাখবে এবং তুরস্কের কুর্দি বিরোধী অভিযানের পাশাপাশি ইসরাইলকে সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সবুজ সংকেত দিয়ে সেখানে একটি ঘোলাটে উত্তেজনাকর প্রেক্ষাপট তৈরী করার পায়তারা করছে বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ঘোলাটে পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে তেলসমস্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা, ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করা এবং জেরুজালেমের উপর ইসরাইলের অধিকার নিষ্কন্টক করাই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে নিওকন মার্কিনীদের অন্তহীন যুদ্ধের এজেন্ডা। পশ্চিমা বশংবদ মুসলিম শাসকরা মসনদ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুসারে চললেও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ কখনো কোনো স্বার্থে আপস করেনা। ভ‚-রাজনৈতিক এজেন্ডার দিক থেকে তুরস্ক এবং সউদি আরবের মধ্যে যেমন বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে গত এক দশকে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে তুর্কি বাহিনী যদি মার্কিন বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে থাকে তা হবে তুরস্কের জন্য অনেক বড় ভুল। বিশেষত: সিরিয়ায় ইসরাইলের যে কোনো অভিযানের বিরুদ্ধে সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার অভিন্ন অবস্থান থাকা জরুরী এ ধরনের যে কোনো অভিযানের পাল্টা জবাব দেয়ার জন্য তাদের সমন্বিত ও সম্মিলিত প্রস্তুতি থাকতে হবে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে পাঠানো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি চিঠি এখন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। পড়েই বোঝা যাচ্ছে, চিঠির ভাষা অমার্জিত এবং প্রচ্ছন্ন হুমকিযুক্ত। এক সময়ের মার্কিন এলি কুর্দি বাহিনী ও কুর্দি জনগণের উপর নির্বিচার হামলা না চালানোর বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে পত্রের শেষ লাইনে বলা হয়েছে, ‘ডোন্ট বি টাফ গাই,ডোন্ট বি ফুল’। তিনি যেন হাজার হাজার মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ও কলঙ্কিত না হন, একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রু তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংসের দায় বহন করতে চায় না। এমন সব বিষয়ের মিশেলে লেখা চিঠিটি নাকি এরদোগান ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন! বাহ্যত এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এরদোগান মার্কিন প্রেসক্রিপশনে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। তবে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতার আলোকে এ সপ্তাহে পুতিনের সাথে এরদোগানের সম্ভাব্য বৈঠকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সিরিয়া সীমান্তে কুর্দি বিরোধী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার রাজনৈতিক ঐক্য ও ভৌগলিক অখন্ডতার প্রশ্নে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মানচিত্র নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধ পরিকল্পনা করেছিল পরিবর্তিত বাস্তবতায় এ অঙ্গীকার সিরিয়ার পক্ষে অনেক বড় ইতিবাচক অগ্রগতি। সেই সাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, সিরিয়া তুরস্ক সীমান্তে তুরস্কের কিছু সমস্যা থাকলেও সেটা আমাদের সীমান্ত নয়, অতএব সেখানে আমাদের সৈন্যদের প্রাণহানির ঝুঁকি নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আহা- এটাই যদি মার্কিনীদের আসল মনোভাব হত তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতি আমূল বদলে যেত এবং বিশ্বের অন্তত অর্ধশতাধিক দেশের আঞ্চলিক সীমান্তে উত্তেজনা, মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি, সমরসম্ভার ও অস্থিতিশীলতা থাকত না। তবে সিরিয়া যুদ্ধ এই মুহূর্তে তুরস্কের কুর্দি বিরোধী যুদ্ধে রূপ নেয়ার প্রেক্ষাপট যাই হোক, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন অবস্থানের ভরাডুবির সূচনা হল বলে পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন। সাংবাদিক কলামিস্ট রবার্ট ফিস্ক মধ্যপ্রাচ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পলিসি ও পতনের ঘটনাক্রমকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমের সাথে তুলনা করেছেন। রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ক্যাটো দ্য সেন্সরের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণের অদ্ভুৎ সাজুয্য তুলে ধরেছেন ফিস্ক। ক্যাটো একজন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী-লেখক-দার্শনিক রাজনীতিবিদ ছিলেন, যিনি কথায় কথায় প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্য কার্থেজ ধ্বংসের হুমকি দিতেন। ঠিক একইভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনো আফগানিস্তান, কখনো ইরান, কখনো উত্তর কোরিয়াকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। কার্থেজের বিরুদ্ধে অনবরত হুমকি দিয়ে যেমন রোমান সাম্রাজ্যের শেষ রক্ষা হয়নি, ঠিক একইভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। সিরিয়া যুদ্ধের বল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তা এখন তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইরানের কোর্টে। তারা ঠিকমত খেলতে পারলে এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবি। কুর্দিদের প্রতি তুর্কিদের চরম অসহিষ্ণুতা এবং নিষ্ঠুরতা দেখে সংশয় জাগে। কুর্দিদের ঐতিহাসিক- রাজনৈতিক দাবীর প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব? ফিলিস্তিন, কাশ্মীরের মত কুর্দি ও রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা অথবা জাতিগত নিরাপত্তার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বিশ্বশান্তির পথ অনেকটা সুগম হতে পারে। এই চারটি জাতিগত সমস্যাই মুসলমানদের। এসব সমস্যা শত বছর ধরে মুসলমানদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংহতিকে অস্থিতিশীল ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ শক্তি এসব জাতিকে ব্যবহার করে তাদের সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। কুর্দিদের মধ্যে জন্ম নিয়ে সালাউদ্দিন আইয়ুবি ইউরোপের খৃষ্টানদের সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীকে পরাজিত করে জেরুজালেম নগরী পুনরুদ্ধার করে তা রক্ষা করেই ক্ষান্ত হননি, যুদ্ধের মধ্যেও মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন। কুর্দিরা ঐতিহাসিকভাবেই সাহসী যোদ্ধা জাতি। সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৩ কোটি কুর্দি মুসলমান শত বছরেও নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নটি পরিত্যাগ করেনি। কুর্দি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে যাযাবর। বড় শক্তির বিরুদ্ধে এই যাযাবর যোদ্ধা জাতির বিদ্রোহের ইতিহাসও অনেক পুরনো। উসমানীয় খিলাফতেও তারা বিদ্রোহ করেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশ বৃটিশদের অধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার শত বছর আগে উসমানীয় সুলতানরা ১৮৪৭ সালে কুর্দিদের আংশিক স্বাধীনতা দিয়েছিল, যা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কুর্দি জনসংখ্যা এতটাই বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত যে তাদেরকে ভ‚-রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে তাদের অবস্থা অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ইহুদি জনগোষ্ঠির মত। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে বর্তমানে তুরস্কে প্রায় ২ কোটি বেশি কুর্দি বাস করে। ইরান, সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দি জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপের গন্ডি ছাড়িয়ে কুর্দি জনগোষ্টির বেশ বড় ডায়াসপোরা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে জার্মানীতে প্রায় ১৫ লাখ কুর্দি বাস করে। এছাড়া ফ্রান্স, সুইডেন, রাশিয়া, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ২০টি দেশে কয়েক লাখ কুর্দি নাগরিক বসবাস করছে বলে জানা যায়। ক্রুসেড বিজয়ী সালাউদ্দিন আইয়ুবির উত্তরাধিকারিদের জন্য কোনো রাষ্ট্র গঠনে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর অনীহার কারণেই কুর্দি জাতীয়তাবাদিদের স্বপ্ন পুরণ হয়নি। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইরাকের কুর্দিরা ইঙ্গ-মার্কিন ও ইসরাইলের সমর্থনে ইতিমধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌছেছে। মার্কিন ও জায়নবাদিরা কুর্দিদের নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে। কুর্দি স্বায়ত্বশাসন অথবা রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিম বিশ্বের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলে সকলের জন্যই মঙ্গল। কুর্দিদের অবস্থা ফিলিস্তিনী, কাশ্মিরী বা রোহিঙ্গাদের মত না হলেও তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নটিকে অগ্রাহ্য করা যায় না।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Munna ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৫ এএম says : 6
মুসলিম বিশ্বের খলিফা হওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখা এরদোগান আমেরিকানদের সহজ চালের কাছে ধরা খেল। লোভ সামলাতে না পেরেই এই পরিনতি। সিরিয়ায় আগ্রাসনে আঞ্চলিক পরাশক্তি ইরান আর রাশিয়া তার উপর খেপে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য ফ্যক্টর দেশ সৌদি আরবের সাথে তার আগে থেকেই দা-কুমড়া সম্পর্ক। ইউরোপের সাথে সম্পর্কও তলানিতে। দুস্কর্মের সমর্থনদাতা ইমরান খান কি এযাত্রা তাকে উদ্ধার করতে পারবে?
Total Reply(0)
ইসমাইল ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৫ এএম says : 0
এই এলাকা যেহুতু সিরিয়ান ভূমি সেই জন্য এর এলাকার বিষয় সে কোন সিধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শুধু বাসাশ সরকার এ রয়েছে
Total Reply(0)
Munna ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৫ এএম says : 1
উচ্চাভিলাসী এরদোগান পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। কুয়েতে যেই ভুল সাদ্দাম করেছিল, একই ভুল করে কুর্দিদের উপর নিজের ক্ষমতা জাহির করতে গেছে। তার এই ভুলই তুরস্ককে ডোবাবে।
Total Reply(0)
তানভীর ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৫ এএম says : 2
who will save erdogan now?
Total Reply(0)
Saimon Hossain ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৬ এএম says : 0
"তুরস্ক-সিরিয়া সংঘাত একেবারেই অগ্রহণযোগ্য..."
Total Reply(0)
Mohammad Hasan ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৬ এএম says : 0
কিছু মাথা মোটা কাশ্মীর আর কুর্দিরে সাথে মিলেয়ে তাদের মন্তব্য জাহির করে।এরদোয়ানের পার্টিতেই কুর্দি মন্ত্রী এমপি আছে এমনকি এই অভিজানে কুর্দি সৈন্য আছে যারা অভিজানে প্রতক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করছে। ৩০ লাখ সিরিয়ানদের বিতারিত করে যারা সিরিয়ানদের নিজস্ব ভূমে দখল করে আছে সেইসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কেবল এই অভিজান।
Total Reply(0)
Abdullah Al Masud ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৭ এএম says : 1
তুরস্ক মুসলিম হয়েও কুর্দি মুসলিম কেমনে মারে? এরদোয়ান কি শুধু লোক দেখানো মুসলিম?
Total Reply(0)
Al Shahriar ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ২:১৮ এএম says : 0
এরদোয়ানের উচিৎ আসাদের সাথে চুক্তি করে সব সিরিয়ানদের সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো কিন্তু সিরিয়ার সাথে যুদ্ধ করলে নিজেরা শেষ হয়ে যাবে।
Total Reply(0)
আবু আব্দুল্লাহ ২৩ অক্টোবর, ২০১৯, ১১:৩৮ এএম says : 1
এরদোগানের অধিকার রয়েছে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সিরিয়ানদের সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো, আমাদের দেশেও শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার থাকলে আমরা ও বার্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রুহিঙ্গাদের বার্মায় ফেরত পাঠাতে পারতাম
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন