ভৈরব, রূপসা, পশুর ও ময়ূরী নদীর পানি ক্রমশ ব্যবহারযোগ্যতা হারাচ্ছে। এসব নদীর পানির নমুনা পরীক্ষা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্যবহারযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। সাগরের লোনা পানি নদীগুলোতে প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে এবং সব পানি পুনরায় সাগরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। একাংশ নদীগুলোতেই থেকে যাচ্ছে। এভাবে নদীগুলোর পানিতে লবণাক্ততার সম্প্রসারণ ঘটছে। ভৈরবের নওয়াপাড়া ঘাট ও চরের হাটের পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পানিতে ডিও ও বিওডি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকলেও লবণাক্ততার মাত্রা অনেক বেশী; শুকনা মওসুমে মানমাত্রা ১৪ পিপিটি। রূপসার লবণচোরা ঘাট ও রূপসা ঘাটের পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে ডিও পরিমিত ও বিওডি’র মাত্রাও ভালো। তবে লবণাক্ততার কারণে শুকনো মওসুমে মানমাত্রা ১৮ পিপিটি পর্যন্ত। মংলাঘাটে পশুর নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ডিও’র মানমাত্রা নীচে ও বিওডি সন্তোষজনক। লবণাক্ততা বৃদ্ধিজনিত কারণে শুকনো মওসুমে মানমাত্রা ২২ পিপিটি পর্যন্ত। ময়ূরী নদীর অবস্থা আরও করুণ। এর ডিও ও বিওডি আশংকাজনকভাবে মানমাত্রার নীচে। পিপিটিও নিম্নে। এছাড়া এ নদীতে অন্যান্য দূষণের মাত্রাও বেশী। এই চার নদীর পানির ব্যবহারযোগ্যতা হ্রাসের প্রধান কারণ অভিন্ন নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যখন অভিন্ন নদীতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক ছিল তখন আমাদের দেশের নদীগুলো ছিল খরস্রোতা। তখন সাগর থেকে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে নদীগুলোতে স্থায়ী হতে পারতো না। প্রবল স্রোত তাদের পুনরায় সাগরে ফিরিয়ে দিতো। এভাবে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা পেতো নদী, পানি ও তীরবর্তী ভূমি। বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ধরে ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে ইচ্ছেমতো পানি সরিয়ে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অধিকাংশ নদী এ কারণে পানি শূন্য হয়ে পড়ে। বড় নদীগুলো পরিণত হয় খালে। এই পানিশূন্যতা, স্রোতহীনতার অন্যতম প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাগরের লোনা পানির আগ্রাসন ক্রমাগত বাড়ছে।
প্রয়োজনীয় পরিমাণে মিঠাপানির সংস্থান ছাড়া জীবন অচল। শুধু জীবনই নয়, জীবিকা ও উৎপাদনসহ কোনো কিছুই মিঠাপানি ছাড়া সচল রাখা সম্ভব নয়। আমাদের পরম সৌভাগ্য, আবহমানকাল ধরে এ ভূখ-ে মিঠাপানির প্রাচুর্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনো বর্ষা মওসুমে দেশের ওপর দিয়ে যে পরিমাণ মিঠাপানি সাগরে পতিত হয়, তা যদি সাগরে না পতিত হতো তবে গোটা দেশ ২৫ থেকে ৩৫ ফুট পানির নিচে থাকত। এই বিপুল মিঠাপানির সামান্য অংশও যদি আমরা সংরক্ষণ করতে পারতাম তাহলে শুকনো মওসুমে পানির কোনো অভাব হতো না, নদী ক্রমশ মরে যেত না, নদীতে পানির প্রবাহস্বল্পতাও থাকত না। শুধু খুলনা নয়, খুলনা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত বিশাল ভূখ- লবণাক্ততা বিস্তারের মারাত্মক হুমকির মধ্যে পতিত হয়েছে। সাগরের পানি নদীতে ঢুকে শুধু পানিই লবণাক্ত করে দিচ্ছে না, সেই সঙ্গে এর তীরবর্তী ভূমি ও ক্ষেত-খামারেও লবণাক্ততা ছড়িয়ে দিচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে জমি বন্ধ্যা হয়ে যচ্ছে, গাছপালা মরে যাচ্ছে, জীবনবৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং আবাদ-উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কথাও উল্লেখ করা দরকার যে, আগের চেয়ে এখন বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। নদীগুলোও অনেক বেশি ভরাট হয়ে গেছে। ফলে লবণাক্ততার বিস্তার দ্রুত ঘটছে। নদীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া লবণাক্ততার বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়। জীবন-জীবিকা, উৎপাদন, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য মিঠাপানির প্রধান প্রাকৃতিক উৎস নদীকে সারা বছর সজীব, সচল, উদীপ্ত ও বেগবান রাখার বিকল্প নেই। ওয়াকিবহাল মহলে অজানা নেই, ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেমন লবণাক্ততার বিস্তার ঘটছে তেমনি উত্তরাঞ্চলে ঘটছে মরুরবিস্তার। দেশ ও দেশের মানুষ কতটা বিপন্নতার মধ্যে পতিত হয়েছে, এ থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।
বলা হয়, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ পানি, এক ভাগ স্থল। আসলেই পানির কোনো অভাব নেই। সাগর-মহাসাগরের দিকে তাকালেই তা বুঝা যায়। কিন্তু এই সাগর-মহাসাগরের পানি পানযোগ্য ও সব ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য নয়। পৃথিবীতে পানযোগ্য-ব্যবহারযোগ্য মিঠা পানির অভাব রয়েছে এবং এ অভাব দিনকে দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন, পানি সংকট বাড়বে, পানি নিয়ে বিসম্বাদ বাড়বে এবং বাড়বে সংঘাত-সংঘর্ষ। তাদের কেউ কেউ এও বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি হয় তবে পানি নিয়েই হবে। বিশ্বের দেশে দেশে পানি নিয়ে বিরোধ-সংঘাত বাড়ছে। এমন কি একই দেশের একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের বিরোধ চলছে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে। এই পটভূমিতে ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত হিস্যা দেবে, শুকনো মওসুমে আমাদের মৃত ও মৃতপ্রায় নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাবেÑ এ আশা, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোয়, দুরাশা বলেই মনে হয়। কিন্তু যত কিছুই হোক, পানির মামলা ছাড়া যাবে না। তা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সংযুক্ত। দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে কিছু হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে শুকনো মওসুমে প্রয়োজনীয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য যত বিকল্প আছে গ্রহণ করতে হবে। সংস্কার, শাসন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী নাব্য করে তুলতে হবে। নদী-খাল-বিলকে পানি সংরক্ষণাগারে পরিণত করতে হবে। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ দ্রুতায়িত করতে হবে। সাগর থেকে লবণাক্ত পানির প্রবেশ ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণসহ লবণাক্ত পানি দ্রুত সাগরে ঠেলে দেয়ার কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের স্বার্থেই নদী বাঁচাতে হবে, তার পানি ব্যবহারযোগ্য রাখতে হবে, মিঠা পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরী বললেও কম বলা হয়। সরকার অনেক ক্ষেত্রে মহা মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সে সব প্রকল্পের চেয়ে এ ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অনেক বেশী প্রয়োজনীয় ও আবশ্যকীয় বলেই আমরা মনে করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন