মাদারীপুরে কলেজশিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া কলেজছাত্র গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে। তার নিহত হওয়ার বিষয়ে যে বিবরণ পুলিশের তরফে দেয়া হয়েছে তাতে নতুন কিছু নেই। অতি পুরনো, অতিকথিত কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সচেতন মানুষ ক্রসফায়ারের এই গল্প বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, এটা সন্ত্রাসীদের টার্গেট কিলিংয়ের মতোই এক ধরনের টার্গেট কিলিং বা ‘পরিকল্পিত হত্যাকা-’। ফাহিমের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। রিমান্ডে থাকা আসামি হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় এভাবে নিহত হতে পারে, এটা কারো পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে এবং নিñিদ্র প্রহরার মধ্যে থাকার পরও যদি কেউ নিহত হয়, তবে তার দায় পুলিশ এড়াতে পারে না। ফাহিম ছিল রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার ঘটনায় একমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামি। তার গ্রেফতার করার কৃতিত্ব পুলিশের নয়, জনতা হাতেনাতে ধরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। গত কয়েক দিনে পুলিশের তরফে তার সম্পর্কে নানা কথা বলা হয়েছে। তার কাছ থেকে হামলার উদ্দেশ্য, হামলায় আরো কারা জড়িত ছিল, নেপথ্যে কারা ছিল, এসব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেত। একমাত্র সূত্রটি না থাকায় অনেক কিছুই হয়তো জানা সম্ভব হবে না। প্রকৃত অপরাধী ও কুশীলবরা হয়তো আড়ালেই থেকে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল এ প্রসঙ্গে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রাষ্ট্র কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এ অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। রাষ্ট্র যদি আইন হাতে তুলে নেয় তবে নাগরিক নিরাপত্তা দেবে কে?
রিমান্ডের আসামির ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত ভয়াবহ ও মারাত্মক। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের হেফাজতে যখন আসামি থাকে, তখন সকল দায় রাষ্ট্রের। একজন শিক্ষককে হত্যা করতে গিয়ে সে ধরা পড়ল। পরে পুলিশ বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এরপর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় কিভাবে এটা হলো, তা সাধারণ বুদ্ধিতে ধরে না। বলা বাহুল্য, সাধারণ বুদ্ধিতে না ধরার কিছু নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেছেন, বড় কোনো ঘটনাকে আড়াল করার জন্য এ ঘটনা ঘটানো হলো কি না এ ধরনের প্রশ্ন জনগণের মধ্যে আসতে পারে। কোনো প্রশ্ন নয়, বিএনপির তরফে তার সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতেই ক্রসফায়ারে ফাহিমকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ক্রসফায়ার সম্পর্কে বলেছেন, প্রথমে অপরাধীদের ধরে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেই অপরাধীরা রিমান্ড থেকে আর জেলখানায় বা তাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যায় না। সোজা চলে যায় ক্রসফায়ারে। হয়তো অপরাধী এমন কিছু তথ্য দেয় যার ফলে সরকারই জড়িয়ে যাবে। এ জন্য তখন তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সবারই ধারণা, এমন কোনো কারণ হয়তো থাকতে পারে, যে জন্য ক্রসফায়ারে ফাহিমকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই হামলায় ঘটনার রহস্য উদঘাটনই নয়, আরো অনেক কিছু জানার জন্য তাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি ছিল। প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে যে কাহিনী শোনানো হয় তা একই রকম হওয়ায় সন্দেহ জাগায়। গত সাড়ে তিন বছরে ক্রসফায়ার ও পুলিশ হেফাজতে ৪৫৬ জন নিহত হয়েছে। সবার গল্পই এক। আবার পুলিশের দাবি মেনে নিলে আসামিদের নিরাপত্তা দিতে তার ব্যর্থতাই বড় হয়ে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয়, এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারের একটি ঘটনাতেও প্রতিপক্ষের কাউকে আটক করতে দেখা যায়নি। ঘটনায় একজনই ক্ষতিগ্রস্ত (নিহত) হয়, যে পুলিশের হাতে আটক ছিল। জানা গেছে, এযাবৎ সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-গুলোর মধ্যে অন্তত ১০টি ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ৮ জনকে শনাক্তের দাবি করেছিল পুলিশ। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই ক্রয়সফায়ারে নিহত হয়েছে। বলতে হয়, তাদের ক্রসফায়ারের মাধ্যমে সবকিছু আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই যদি প্রকৃত বাস্তবতা হয়, তবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মোকাবেলা কিভাবে হবে, কিভাবে দমন করা যাবে সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের?
ক্রসফায়ার ভয়ঙ্কর ভীতি ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা একটা নিয়মিত ও সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এর সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত ১৩ দিনে অন্তত ১৮ জন ক্রয়সফায়ারে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে এমন ৬ জন ছিল, যারা পুলিশের মতে সন্দেহভাজন জঙ্গি। তাদের নিহত হওয়ার পর জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছুই আর জানা যাবে না। সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা মোকাবেলার মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি হামলা ও হত্যাকা-ের নিরপেক্ষ তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেফতার ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে সংঘটিত এ ধরনের হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনার কোনোটারই তদন্ত শেষ হয়নি; বিচার শাস্তি তো পরের কথা। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চলছে। অভিযান-সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে; নিয়মিত ধরপাকড় তো আছেই। অথচ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, যখন তখন যেখানে সেখানে এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো শেষ নেই। এদিকে পুলিশের অভিযান, গ্রেফতার বাণিজ্য, জুলুম-পীড়ন, ক্রসফায়ার ইত্যাদিতে মানুষ অতিষ্ঠ ও শঙ্কিত। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র সে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন হাতে তুলে নেয়ার অভিযোগ পর্যন্ত উঠছে। এমতাবস্থায়, মানুষ কোথায় যাবে? এখন মানুষের অধিকার উপেক্ষিত, নিরাপত্তা অনিশ্চিত এবং দুঃখ-দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা সীমাহীন। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন না থাকায় এই নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তরণে রাজনৈতিক ঐকমত্য, সমঝোতা এবং কার্যকর উদ্যোগের বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন