যানজট ও রাস্তাঘাটের নানা বিড়ম্বনা এবং মার্কেটের ঠেলাঠেলি সামলে শপিং করার দিন মনে হয় শেষ হতে চলেছে। এখন ঘরে বসেই ক্রেতারা তাদের পছন্দের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছেন। ধীরে-সুস্থে, বুঝে-শুনে পছন্দ করে অর্ডার দেয়ার অল্প সময়ের মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাচ্ছে কাক্সিক্ষত পণ্য। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও এখন অনলাইন শপিং ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ছেলে-মেয়েদের পোশাক, কসমেটিকস, জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগসহ সব ধরনের শৌখিন পণ্য কেনা-বেচার ক্ষেত্রে অনলাইন শপিং বা ই-কমার্স বেশ জমে উঠেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ ইউরোপ-আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই অনলাইন শপিং অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এতে মার্কেটে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা ও দামাদামির কসরতের মধ্যে পড়তে হয় না। সময় ও শ্রম দুটোই সাশ্রয় হয়। দামও মার্কেটের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। অনলাইনে পণ্য পছন্দ করে অর্ডার দিলেই দ্রুততম সময়ে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। বাংলাদেশে অনলাইন এই বিজনেস দ্রুত প্রসার লাভ করছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশের এটি একটি মাধ্যম এবং ব্যবসার এক অপার সম্ভাবনা হয়ে উঠেছে।
এ কথা অনস্বীকার্য, মার্কেটে গিয়ে ঘুরে ঘুরে শপিং করা অনেক ক্রেতারই প্রিয়। তবে যানজট পেরিয়ে অধিক সময় ব্যয় করে মার্কেটে শপিং করা এখন ক্রেতাদের কাছে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ঈদ বা অন্যান্য উৎসবের দিনগুলোতে মার্কেটে যখন উপচে পড়া ভিড় থাকে, তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না, তখন শপিং করা অনেকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ভিড়ের সুযোগও নিচ্ছে দোকানদাররা। তারা যেমন খুশি তেমন দাম হেঁকে ক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে। ক্রেতারাও নিরুপায়। উল্লেখ্য, ক্রেতাদের সচ্ছন্দে শপিং করার জন্য রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোতে সুরম্য অট্টালিকায় অসংখ্য শপিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এসব শপিং সেন্টারের সেন্ট্রাল এসিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার উল্লেখ করে বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে। ঈদ এলে তো লাকি কুপন ড্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ক্রেতারাও এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে মার্কেটগুলোতে ভিড় করেন। যেখানে বড় ও আকর্ষণীয় শপিং মল গড়ে উঠেছে, দূর হলেও কষ্ট স্বীকার করে সেখানে হাজির হন। এতে যেমন তাদের সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়, তেমনি অধিক অর্থও খরচ করতে হয়। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই শপিংয়ের ধারণা এখন বদলে দিয়েছে ইন্টারনেট। যে কেউ ইচ্ছা করলে মার্কেটে লাখ লাখ টাকা দিয়ে দোকান না নিয়ে ঘরে বসেই ব্যবসা করতে পারেন। এজন্য ফেসবুকে গিয়ে পছন্দসই একটি নাম দিয়ে ‘লাইক পেইজ’ খুলে সেখানে পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ, মূল্য ও ফোন নম্বর দিয়ে ছবি আপলোড করলেই হয়। ক্রেতারা এই পেইজে ঢুকে পণ্য দেখে প্রয়োজনে সরাসরি কথা বলে বিস্তারিত জানতে পারেন। পছন্দ হলে অর্ডার দেবেন, না হলে দেবেন না। আবার পছন্দ করে অর্ডার দেয়া পণ্য বাড়িতে পৌঁছার পর পছন্দ না হলে ফেরতও দিতে পারেন। এতে শুধু ক্রেতাকে যাতায়াতের ভাড়াটুকু দিতে হয়। মার্কেটের দোকান থেকে কিনলে এ ধরনের সুবিধা খুব কমই পাওয়া যায়। অনেক সময় পণ্য ফেরত নেয়া হয় না। একটার পরিবর্তে আরেকটা নিতে হয়। পছন্দ না হলেও অর্থ ফেরত দেয়া হয় না। অনলাইনে ক্রেতাদের এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। ফলে অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি অনেক ক্রেতাই এখন ঝুঁকেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ই-কমার্স বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই বছরে রাজধানী ও এর আশপাশসহ বড় শহরগুলোর কেনাকাটার চরিত্রে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। চিরাচরিত মার্কেটগুলোতে ভিড় কমেছে শতকরা ৪০ ভাগ। ১৬ থেকে ৫৫ বছরের ক্রেতাদের বেশির ভাগই অনলাইনে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে বেশি। ক্রেতাদের মতে, মার্কেটের চেয়ে অনলাইনে অল্প দামে ঝামেলাহীনভাবে পণ্য কেনা যায়। এ কারণে বিশ্বব্যাপী অনলাইন শপিং এখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামাজন ডটকম সারা বিশ্বে তাদের অনলাইন বিজনেস চালিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় একটি সাইটে পরিণত হয়েছে। এমন আরো বেশ কয়েকটি সাইট রয়েছে যেগুলো অনলাইন বিজনেসে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। আমাদের দেশেও কিছু অনলাইন ইতোমধ্যে লাইম লাইটে চলে এসেছে এবং জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। অনলাইন ব্যবসার সাথে স্টুডেন্ট থেকে শুরু করে গৃহিণীরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ছেন। এতে অল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করা যায়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে তাদের তালিকাভুক্ত প্রায় ৯ হাজার অনলাইন শপিংয়ে সাইট ও ফেসবুক পেইজ রয়েছে। এসব বিজনেস মাধ্যমে প্রতি বছর লেনদেন হয় ৫০০ কোটি টাকারও বেশি এবং তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, তাদের তালিকাভুক্ত বিজনেস সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ও ফেসবুকের সংখ্যা ৮ হাজার। এছাড়া তালিকার বাইরে আরো অসংখ্য পেইজ রয়েছে। এসব পেইজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কেনাকাটার পরিমাণ বাড়ছে। অনলাইনের এই সুবিধার কারণে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানিও শোরুমের পাশাপাশি অনলাইন বিজনেস শুরু করেছেন। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তারাও অনলাইন বিজনেস শুরু করেছেন।
ডিজিটাল জগত মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। পুরো বিশ্বকে হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে। পত্রপত্রিকাসহ, টেলিভিশন, রেডিও এমনকি মোবাইল কলও এখন ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে গেছে। শপিংয়ের বিষয়টিও ইন্টারনেটে চলে এসেছে। যে কেউ চাইলেই অল্প পুঁজি নিয়ে একটি পেইজ খুলে ব্যবসা চালু করতে পারে। এতে তার লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে দোকান কেনা বা ভাড়া দেয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। দোকানের সেলসম্যানের মতো এক-দুইজন ডেলিভারিম্যান থাকলেই হলো। বাসায় বসেই ব্যবসা শুরু করা যায়। ই-কমার্সের এই অগ্রসরতা নিঃসন্দেহে একটি বিরাট পদক্ষেপ এবং সামনের দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলার অপার সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। আমাদের দেশে এর দ্রুত প্রসার ঘটলে আবাসিক এলাকাসহ যত্রতত্র বিশৃঙ্খলভাবে মার্কেট গড়ে ওঠার হার কমে আসবে। পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যক বেকার তরুণের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ ঘটবে। তবে এই অনলাইন ব্যবসায় শুধুমাত্র পোশাক-আশাক বা কসমেটিকস ও শৌখিন পণ্যসামগ্রী নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের ব্যবসা শুরু হওয়া উচিত। এতে ক্রেতারা যেমন সচ্ছন্দে জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারবে, তেমনি এ ব্যবসার সাথে জড়িতরাও ব্যাপক লাভবান হতে পারবে। ভিন্ন ধরনে ও অল্প পুঁজিতে ব্যবসার নতুন একটি দিগন্ত খুলে গেছে। সময়ের প্রয়োজনে ও যুগের সাথে তাল মেলাতে ডিজিটাল এ ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটবে বলে আশা করা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন