বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণপরিবহনে নারী নিগ্রহ

আজহার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

সময়ের স্রোত যত বাড়ছে আমরাও তত উন্নত এবং আধুনিক হচ্ছি। দেশও উন্নত এবং আধুনিক হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতা এসব কি আধুনিক হচ্ছে? বিষয়টা সত্যিই চিন্তার। আমরা আমাদের রুচি আর মানসিকতাকে সেই আগের জায়গায় ফেলে রেখেছি। বাকি সবকিছুতে আধুনিক হতে পেরেছি তবে মানসিকতায় নয়। এসব এজন্যই বলছি, আমাদের দেশে এখনও নোংরামী আর নোংরা মানসিকতার মানুষরা পরিবর্তন হতে পারেনি।

হ্যাঁ, আমি গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে বলছি। গণপরবিহন কতটা নারীবান্ধব এটি নিয়ে নানা সময়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও কোনক্রমেই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এই সেক্টরে। নারীরা গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে নানা সহিংসতার শিকার হন। এমনকি গণধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে। যে কারণে বাংলাদেশে শতকরা ৪৯ ভাগ নারী গণপরিবহনকে অনিরাপদ মনে করেন। এটা মনে করারও বিষয় নয়। এটা বিশ্বাস করার বিষয়। আমাদের দেশের গণপরিবহনগুলোতে নারীরা যে অনিরাপদ সেটা মিথ্যা কিছু নয়। এর কারণ এখানে প্রতিবাদের সংস্কৃতি অনুপস্থিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমারা খুব কম পুরুষই এর প্রতিবাদ করি। যার কারণে এসব গণপরিবহনে একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে।

আমি যদি একটু পেছন থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি, তাহলে প্রথমে বলতে হয় ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি মানিকগঞ্জে শুভেচ্ছা পরিবহনে চলন্ত একটি বাসে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা। ওই ঘটনায় বাসচালক ও সহযোগী গ্রেফতার হন। এরপর ২০১৫ সালের ১২ মে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে ফেলে দেয় বাসচালক ও চালকের সহকারী। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি বরিশালে সেবা পরিবহনের একটি বাসে দুই বোনকে ধর্ষণ করে পাঁচ পরিবহনকর্মী। গত বছরের ২৫ আগস্টের কথা। ময়মনসিংহের একটি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত রূপা, বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাসে ময়মনসিংহ ফিরছিলেন। রূপা যে বাসে ফিরছিলেন সে বাসটি ঐদিন রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা অতিক্রম করার পর সব যাত্রী নেমে যায়। এরপর বাসটি কালিহাতি এলাকায় পৌঁছার পর বাসের মধ্যেই ধর্ষণের শিকার হন রূপা। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় মধুপুর এলাকার জঙ্গলে। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি বাসে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে বাসচালকসহ তিন পরিবহনকর্মী।

চলতি বছরের ৬ মে আবারও চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শাহিনুর আক্তার তানিয়া নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি পিরিজপুরে আসার জন্য ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে কটিয়াদি আসার পর তানিয়া ও অপর দুই যাত্রী ছাড়া বাকি সবাই নেমে যান। কিছু দূর যাওয়ার পর অন্য দুই যাত্রীও নেমে যায়। বাসটি কিশোরগঞ্জ-ভৈরব সড়কের বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের বিলপাড় গজারিয়া নামক স্থানে পৌঁছানোর পর তাকে ধর্ষণ করা হয়। সবকিছু মিলিয়ে গণপরিবহন যেন নারীর জন্য এখন এক আতঙ্কের নাম। প্রতিটি মুহূর্তে একজন নারীর ভয়ে থাকতে হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমীক্ষা অনুযায়ী, গত এক বছরে গণপরিবহনে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা ২১।
সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক তা আমরা সকলেই অনুভব করতে পারছি কিছুটা। গণপরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের বড় অংশই বলেছেন, নানাভাবে তারা হয়রানির শিকার হয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু অবস্থা এমন যে, অধিকাংশ নারীই সেটি প্রকাশ করতেও বিব্রত বোধ করেন। শিক্ষা ও চাকরিসহ নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন হাজার হাজার নারীকে ঘরের বাইরে বেরুতে হয়। অধিকাংশেরই একমাত্র ভরসা হলো বাস, মিনিবাস কিংবা টেম্পোর মতো গণপরিবহন। অথচ এসব বাসেই নারীদের সম্ভ্রম হারাতে হয়। তাহলে নারীরা যাবে কোথায়?

আমাদের দেশে যৌন হয়রানি বন্ধে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় সহায়তা চাইতে গেলে পুলিশের কাছে তেমন কোনো সহযোগিতাও পাননা নারীরা। সম্প্রতি এমন অভিযোগ করেছেন বেশকিছু ভুক্তভোগী নারী। উল্টো নারীদের যেসব প্রশ্ন করা হয় সেগুলোও এক ধরনের নিগ্রহ। তাহলে নারীদের উপর এ অমানবিতার দায় কে নেবে?

আমরা সকলেইতো সাধু। কিন্তু আমরা এমন এক ধরনের সাধু, যারা চোরের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না। আসলে আমরা ভন্ড। আমাদের মুখোশের আড়ালে বাস করে এক একটা পশু। কেউ বাসে কেউ ঘরে। ধর্ষণ, নির্যাতন নারীর উপর চলছেই।

বর্তমানে নারীদের রাস্তা-ঘাটে যে হয়রানি করা হয়, তা থামানোর জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি সামগ্রিক উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ। নারী-পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার অসম সম্পর্ক আমাদের সমাজে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণের যে ক্রমবর্ধমান হার তা আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে সবাইকে। প্রতিটি পরিবার থেকে নারীকে যথাযথ শিক্ষা দেয়ার, স্বাধীনভাবে গড়ে তোলার, ক্ষমতায়িত করার প্রচেষ্টা থাকে। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। কারণ প্রতিটি পরিবারই নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটান।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এ সমস্যার পরিত্রান পেতে চায় সকল নারী। এ জন্য প্রয়োজন পুরুষদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করা। শুধু তাই নয়, গণপরিবহনের মালিক, শ্রমিক এবং তাদের সংগঠনগুলো আন্তরিকভাবে এগিয়ে না এলে শুধু সরকার, আইন কিংবা শাস্তি দিয়ে এই ব্যাধির নিরাময় সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। নারীর নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজকেও সোচ্চার হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ। তবেই আমাদের সমাজে নারীরা সুন্দরভাবে পথ চলতে পারবে। এগিয়ে যেতে পারবে অনেক দূর।
লেখক: প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
MOHAMMAD ABUL KASHEM ১১ নভেম্বর, ২০১৯, ২:২৬ পিএম says : 0
I propose two points : 1- all the Buses mainly local buses Passengers to reach from back door and down from bus front door (so same time can be get up in the bus and down from the bus without any problem). Or 2- For Ladies can get up in the bus from back side and must make divider in the bus certain place of each bus (base on busy route) and front door for use gents only.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন