ঢাকা বেশ কয়েক বছর ধরে নিকৃষ্টতম বা বসবাসের অযোগ্য নগরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। এবার দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম শীর্ষে চলে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লী, বেইজিং, করাচি, মুম্বাই শহরের বায়ু দূষণ আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হলেও সামগ্রিকভাবে দেশের গড় বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে ভারত, চীন ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনে চলে এসেছে বাংলাদেশ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক দূষণ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ার ভিজুয়্যালের গবেষণা জরিপে বাংলাদেশের বায়ু দূষণের এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বিশ্বের বায়ু দূষণে শীর্ষে থাকা ৩০ শহরের মধ্যে ২২টিই ভারতের, দূষিত বায়ুর বাকি ৮টি শহর পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের। শহরভিত্তিক চিত্র পর্যালোচনা করলে ভারতের দিল্লীকে এক নম্বর দূষিত বায়ুর নগরী হিসেবে স্থান দেওয়া হলেও দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। দিল্লীতে বায়ু দূষণের কারণে দিনের বেলায় সূর্যের আলো ঢেকে যাচ্ছে এবং শ্বাসকষ্টের শিকার হচ্ছে মানুষ। এহেন বাস্তবতা সেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণসহ বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। বায়ু দূষণের কারণে অনেক মানুষ দিল্লী ছাড়ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লীর মতো ঢাকায়ও বায়ু দূষণের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রাণঘাতী রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ এখন বায়ু দূষণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা হেল্থ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই) থেকে প্রকাশিত এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা মোট মৃত্যুর শতকরা ১৪ ভাগ। বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ১ বছর ১০ মাস, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখনো মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ণ ও কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া, লোকালয়ের কাছে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত ইটভাটা, কলকারখানার ধোঁয়া, রাসায়নিক তরল বর্জ্য সরাসরি নদী, খাল ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলার কারণে দূষিত হচ্ছে বায়ু, পরিবেশ, পানি ও মাটি। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও কোটি মানুষকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে আদতে তার বিপরীতমুখী ফলাফলই তীব্র আকার ধারণ করছে। এ ধরনের বাস্তবতায় দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ বা টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব।
নির্মল বায়ু ও বিশুদ্ধ অক্সিজেন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার বিকল্পহীন অবলম্বন। শহরের চাকচিক্য, মেগা প্রকল্প ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনো কাজে আসবে না যদি বেঁচে থাকার অপরিহার্য উৎস বায়ু ও পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে এখন বাতাসে ক্রমবর্ধমান পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম-২.৫) বা অতি সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি জরুরি। আন্তর্জাতিকভাবে পিএম-২.৫ এর সহনীয় মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম হলেও বাংলাদেশে গড়ে এর মাত্রা ৬১ মাইক্রোগ্রাম। আইকিউ এয়ার ভিজুয়্যালের তথ্য অনুসারে, ঢাকা শহরে পিএম-২.৫এর মাত্রা ৯৭.১ মাইক্রোগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য এখন টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। সুজলা-সুফলা নদীমার্তৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি নির্ভর করছে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি মোকাবেলার মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার সঠিক পরিকল্পনার উপর। রাস্তা, ব্রীজসহ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এর দূষণও পরিবেশগত দিকগুলো সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। যত্রতত্র নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রেখে, রাস্তায় গাছ পুড়িয়ে ড্রামে পিচ গলিয়ে রাস্তা উন্নয়ন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হাজার হাজার ইটভাটা, লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং পরিশোধন ব্যবস্থাবিহীন শিল্প কারখানা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বায়ু, পানি ও মাটি দূষণ, পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন