বিশে^র সুইডেন, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, লিশটেনস্টাইন প্রভৃতি দেশ এখন অপরাধী সঙ্কটে পড়েছে। সেসব দেশের কারাগারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বা হতে চলেছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এসব দেশের প্রায় আটানব্বই ভাগ মানুষ। অবাক করা কথা হলো, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের নিউজিল্যান্ডে ইংরেজরা এক সময় দাগী এবং ভয়ঙ্কর অপরাধীদের নির্বাসন দিতে পেনাল কলোনি তৈরী করেছিল, সেই নিউজিল্যান্ডে ভয়ঙ্কর তো দূরের কথা সাধারণ মানের অপরাধীও প্রায় নেই বললেই চলে। এখন প্রশ্ন হলো, কি এমন ‘আলাদিনের জাদুর চেরাগ’ তারা পেলো যার স্পর্শে অসভ্য ও বর্বর জাতি থেকে তারা বিশে^র সবচেয়ে সভ্য, মানবিক জাতিতে পরিণত হলো? কোন জাদুতে তাদের দেশে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে মানুষ হত্যা করা হয় না; প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজ সন্তানের লিঙ্গ কেটে-পেটে ছুরি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় না। এ নিয়ে গবেষণার কি আদৌ প্রয়োজন আছে? না, নেই। পৃথিবীব্যাপী মানুষের মানবিকতা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে আর আমাদের মানবিকতা দ্রুত নিন্মগামী হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাড়ছে শিক্ষার হার, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নৈতিকতা, সহনশীলতা ও মানবতাবোধ। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও নৈতিকতা, সহনশীলতা ও মানবতাবোধ দ্রুতই কমে যাচ্ছে।
আমরা প্রায়ই বিভিন্নভাবে ‘পাশবিক’ বা ‘পৈশাচিক’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। ‘পাশবিক’ শব্দটি এসেছে ‘পশু’ শব্দ থেকে। দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের পরিচয় সে একজন মানব। মানবের নৈতিকতা, সহনশীলতা, মানবিকতা থাকতে হয়। জৈবিক প্রক্রিয়া এবং বংশ বৃদ্ধির জন্য মানুষের প্রজনন প্রক্রিয়া অন্যান্য জীবের মতই। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, জৈবিক গঠনে মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং মস্তিস্কের কাঠামো এবং কর্মক্ষমতা অন্য যে কোনো প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি সুগঠিত। মানুষ চিন্তা-চেতনার অধিকারী। আমাদের মস্তিস্ক আমাদের চারপাশ থেকে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করে স্মৃতি হিসাবে মস্তিস্কে জমা করে রাখে। আমরা আমাদের মস্তিস্কে জমাকৃত তথ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকি। আমাদের বিচার, বিশ্লেষণ, বিচক্ষণতা সবকিছুই ওই সব তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এই কাজটি পৃথিবীর আর কোনো প্রাণি এত ভালোভাবে বা নিখুতভাবে করতে পারে না। এখানেই মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মাঝে তফাত তৈরী হয়।
প্রতিটি প্রাণিই প্রকৃতি থেকেই তার খাদ্যের সংস্থান করে। খাদ্যের সংস্থানে পারতপক্ষে অন্য কোনো প্রাণিকে তারা হত্যা করে না। কিন্তু মানুষ আহারের প্রয়োজনে অন্যকে হত্যা করতেও পিছুপা হয় না। মানুুষের মতো প্রাণিদেরও জৈবিক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তারা কখনোই তার সঙ্গী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণির সাথে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পশুর সাথে, অধিক বয়স্ক পশুর সাথে সঙ্গম করে না। কিন্তু কিছু কিছু বিকৃতমনা মানুষ বয়োবৃদ্ধ, শিশু কাউকেই ছাড় দেয় না। ফলে আমাদের সমাজে ধর্ষণ বাড়ছে প্রতিনিয়তই। আমাদের দেশের মানুষ লোভ, হিংসা আর ক্রোধ ইত্যাদির কারণে তাদের মানবিকতা, নৈতিকতা, সচেতনতা প্রায় ভুলেই যাচ্ছে। এর ফলে ঘটছে নানা ধরণের অপরাধ প্রবণতা। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে বিচিত্র অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে একটি হলো পায়ুপথে বাসায় ঢুকিয়ে মানুষ হত্যা! ২০১৫ সাল থেকে এ বিচিত্র কায়দায় হত্যা শুরু হয়, যা আজোবদি চলমান। গত ২৬ অক্টোবর দেশের প্রায় সব কটি গণমাধ্যমে ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার বা প্রকাশ করা হয়েছে। বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলার একটি জুট মিলে আলাল হোসেন (১২) নামের এক শিশু শ্রমিকের শরীরে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার আকস্মিকতায় দেশের বিবেকবান মানুষ বাকরুদ্ধ। নিহত শিশুর সহকর্মী যতন কুমার (১৭) নামের এক তরুণ এ ঘটনা ঘটায়। পুলিশ যতন কুমারকে গ্রেফতার করেছে। নিহত শিশু আলাল কাহালু উপজেলার ঢাকন্তা গ্রামের মোজাহার আলীর ছেলে।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ২৫ অক্টোবর বেলা পৌনে ১১টায় বিকারগ্রস্থ যতন কুমার মেশিন পরিষ্কার করার হাওয়া মেশিনের পাইপ আলালের পায়ুপথে ঢুকিয়ে বাতাস দেয়। এতে পেট ফুলে আলাল অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে শিশু আলাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল ৩টায় মৃত্যুবরণ করে। এ ধরনের ঘটনা দেশে নতুন নয়। কয়েক বছর ধরে এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। নানা পৈশাচিক কায়দায় মানুষ হত্যার মহোৎসব চলছেই। এর আগেও এ ধরণের পৈশাচিক কায়দায় শিশুসহ নানা বয়সের মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই ঘটনাগুলো দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অপরাধী। মর্মান্তিক এসব ঘটনাগুলো আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিলেও কিছু মানুষের পশুবৃত্তি থেমে নেই।
২০১৫ সালের ৩ আগস্ট বিকেলে খুলনার টুটপাড়ায় শরীফ মোটরস নামে এক মোটরসাইকেলের গ্যারেজে ওই গ্যারেজের মালিক শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টু মিয়া কমপ্রেসার মেশিনের নল পায়ুপথে প্রবেশ করিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করে ১২ বছর বয়সী শ্রমিক রাকিবকে। এ মামলায় হত্যার প্রধান আসামি শরীফসহ দুজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।
২০১৬ সালের ২৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জে ১০ বছরের শিশু সাগর বর্মণকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়।
একই বছরের ২৪ আগস্ট রাজধানীর ভাটারায় ফার্নিচার দোকানের কর্মচারি মামুন নামের এক যুবক ঠিকাদার আতিয়ার মোল্লা (২৮) কে ক¤েপ্রসার দিয়ে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করে।
২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বগুড়ার কাহালুতে ক¤েপ্রসার মেশিন দিয়ে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে রাসেল মিয়া (১৯) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। ওই দিন সকালে কাহালু উপজেলার বীরকেদার এলাকায় এবিসি টাইলস নামে একটি সিরামিক কারখানার শ্রমিক রুবেল হোসেন তার সহকর্মী রাসেল মিয়ার পায়ুপথে জোরপূর্বক বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাসেল অসুস্থ হয়ে পড়লে কারখানার লোকজন তাকে শজিমেক হাসপাতালে নেয়। সেখানে রাসেল মারা যান।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার সত্যভান্দি এলাকায় অবস্থিত নয়াপাড়ার উদয়ন ববিন মিলের শ্রমিক ওই এলাকার মৃত লিয়াকত আলীর ছেলে সুমনের (২৮) পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়।
চলতি বছরের (২০১৯) ৯ মে পাবনা বিসিক শিল্প নগরীতে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দুলাল হোসেন নামে এক সহকর্মীর পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দেয় বরাত হোসেন নামে এক অপর এক শ্রমিক। ১১ মে দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দুলাল।
১৪ জুন ময়মনসিংহের ভরাডোবা এলাকার ভালুকা শিল্পাঞ্চলে গেøারি স্পিনিং মিলে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে পারভেজ নামের এক শ্রমিককে হত্যা করা হয়। তিনি ভালুকা উপজেলার মেদুয়ারি ইউনিয়নের বাসিন্দা জালাল উদ্দিনের ছেলে।
২৩ জুন নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলায়স্থ বৌলাম শাহ সুলতান অটো রাইস মিলে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে মো. শফিকুল ইসলাম (৩৩) নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে নিহতের সহকর্মী রনি মিয়া (৩২)।
২৭ জুন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে ধনু মিয়া (৪০) নামের এক নির্মাণ শ্রমিককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মাসুদ (২২) নামের অপর এক শ্রমিককে আটক করে পুলিশ। অভিযুক্ত মাসুদ আদালতের কাছে অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়।
উপরোক্ত ঘটনাগুলি আমাদের পশুবৃত্তির পরিচয় বহন করে। একটি সভ্য দেশে, সভ্য সমাজের এ ধরনের অমানবিকতা মোটেও কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে যে পাশবিক প্রবণতা আছে, সেই প্রবণতা অজ্ঞাত কারণে বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এসব ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের গভীর এক রোগের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ রোগের দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। সেই সাথে এসব অমানবিক কর্মকান্ড থেকে বিকৃতমনা মানুষদের নিবৃত্ত করতে প্রয়োজন কঠোর আইনের শাসন। অমানবিক এসব ঘটনার বিচার করতে হবে দ্রæততম সময়ের মধ্যে। বিচার বিলম্বিত হলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবার সুযোগ পায়। বিচারের সকল ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করতে হবে। এরই সাথে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষের মানবিকতার উন্নয়ন। আর এটি হতে হবে জনসচেতনতার মাধ্যমে। এ দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে। এসব মানবতা বিবর্জিত কর্মকান্ড থেকে বিকারগ্রস্থ মানুষদের নিবৃত্ত করতে জনসচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন