শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শুদ্ধি অভিযান কি শেষ হয়েছে? বেসিক ব্যাংকসহ হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে অভিযানের কী হলো?

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

শুদ্ধি অভিযান সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যখন এই অভিযান শুরু হয় তখন এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে কনফিউশন শুরু হয়। বলতে গেলে সকলের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে, আসলে সরকার কি চাচ্ছে? এর সুদূর-প্রসারী লক্ষ্য কি? যদি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান হয় তাহলে সেটা ভালো কথা। দুর্নীতি তো শুধু ক্যাসিনোতে নাই, অন্যান্য জায়গাতেও আছে। সেইসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান না করলে এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর এই অভিযানের নতুন নাম শোনা গেলো।

বলা হলো, এটি হলো শুদ্ধি অভিযান। এবার দ্বিতীয় দফা কনফিউশন সৃষ্টি হলো। কারণ শুদ্ধি অভিযানের পরিধি ব্যাপক। শুদ্ধি অভিযানের কথা আমরা শুনেছি গণচীনে, শুনেছি রাশিয়ায়, শুনেছি তুরস্কে, শুনেছি সিরিয়ায়। আরো শুনেছি জার্মানি এবং কিউবায়। এসব দেশের কোনো কোনোটিতে শুদ্ধি অভিযানে ঘটেছে রক্তপাত। আবার কোনো কোনো দেশে রক্তপাতহীন শুদ্ধি অভিযান চলেছে। তবে ঐসব দেশে মেইন টার্গেট ছিল পলিটিক্যাল পার্টি ও লিডার্স। জার্মানিতে বড় বড় নাৎসি নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে রাশিয়াতে, হত্যাকান্ড ঘটেছে চীনে। বাংলাদেশের শুদ্ধি অভিযানে কিছু রাজনৈতিক নেতা পড়েছেন। তবে কোনো রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে বড় ধরণের কোনো দন্ড দেওয়া হয়নি। এখানে অভিযান চলেছে প্রধানত ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান। অর্থাৎ বড় বড় জুয়ার আড্ডার বিরুদ্ধে অভিযান।

এসব দেখে শুনেই কিনা জানি না, সর্বশেষ এই অভিযানের নাম আবারও বদলানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, এটা নাকি সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিযান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেছেন তখন সেটিকে সঠিক হিসাবে ধরতে হবে। কিন্তু অভিযান যেভাবে চলছে তাতে করে সেটিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিযান বলা যায় না। কারণ ক্যাসিনোর জুয়াড়িরা নাকি অনেক মন্ত্রী, এমপি এবং নামজাদা আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে অনেক তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন, তাদের জুয়ার আড্ডায় পুলিশ শুধু অংশ গ্রহণই করতো না, বরং তারা ক্ষেত্র বিশেষে জুয়ার আড্ডা বা ক্যাসিনোকে প্রটেক্ট করেছে। সে জন্য এখন দেখা যাচ্ছে অভিযান তার গতি হারিয়ে ফেলেছে। এটা যে এখন কোন্ ধরণের অভিযান, এই অভিযানের শেষ পরিণতি কি সেটা নিয়ে সকলেই ধোঁয়াশার ভেতরে রয়েছেন।

যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় এটি সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিযান হয়ে থাকে তাহলে আজ পর্যন্ত একজন পুলিশ অফিসারকেও এই স্পেশাল অভিযানে আটক করা হয়নি। পুলিশ কি রাতারাতি ধুয়া তুলসি পাতা হয়ে গেলো? বরং ক্যাসিনোর ডন সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ প্রমুখ নাকি অনেক বড় বড় অফিসারের নাম বলেছেন বলে পত্রিকার পাতায় খবর বেরিয়েছে। অথচ প্রশাসনের একজনের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। প্রশাসনকে যদি সৎ এবং নির্ভীক করতে হয় তাহলে প্রথমেই পুলিশদেরকে তাদের কাজের পূর্ণ স্বাধীনাতা দিতে হবে। বিভিন্ন মহল থেকে যখন যে তথ্য তারা পাবেন তখনই সেখানে তারা অভিযান চালাবেন। বেসামরিক প্রশাসনের অনেক বড় বড় অফিসার এবং পুলিশ প্রশাসনের অনেক মধ্যম পর্যায়ের নাম নাকি ক্যাসিনো ডনরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন অফিসারের গায়েও হাত দেওয়া হয়নি, সেটা পুলিশ হোক কিম্বা অন্য বেসামরিক অফিসার হোক।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ইতোপূর্বে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে সেগুলো এখন বিবেচনায় নিতে হবে। ইতোমধ্যেই কিন্তু বাজারে এসব অভিযান নিয়ে নানান রকমের কথা উঠেছে। সরকারকে যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয়ে তাহলে যখন যে গুরুতর সমস্যা উপস্থিত হয় তখনই সে সমস্যাকে এ্যাড্রেস করতে হবে। এই সময় সারা দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো পেঁয়াজ। ৪০ টাকা দরের পেঁয়াজ এখন ১৬০ টাকা হয়েছে। এটি কি কল্পনা করা যায়? এখন তো পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে এবং জনগণও বলছে যে, একটি বড় পেয়াজের দাম একটি আপেলের চেয়েও বেশি। পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, ভারতে নাকি এখন পেঁয়াজের কেজি ৬ টাকা থেকে ১০ টাকা। সেখানে বাংলাদেশে ১৫০ বা ১৬০ টাকা হয় কীভাবে?

ইতোমধ্যেই পাশের দেশ মিয়ানমার এবং দূরের দেশ মিশর থেকে বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এরপর আর পেঁয়াজের ঘাটতি থাকার কোনো কথা নয় এবং বাস্তবিক পক্ষে কোনো ঘাটতি নাইও। এর পরেও পেঁয়াজের দর ১৫০- ১৬০ টাকা থাকায় এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, পেঁয়াজের বিপুল মজুদদারি হচ্ছে। সিন্ডিকেট বলুন আর যাই বলুন, একটি গোষ্ঠি মিলে এই মজুদদারি করছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা হয়েছে, পেঁয়াজ মজুদ করে একটি বিশেষ সিন্ডিকেট নাকি ইতোমধ্যে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। ৩/৪ হাজার কোটি টাকার মুনাফার খবর শতভাগ সত্যি হতেও পারে, নাও পারে। তবে বিপুল পরিমাণ মজুদদারি যে হচ্ছে এবং শত শত কোটি টাকা যে মুনাফা লুটা হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। সরকার যদি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান সত্যিই চালাতে চায় এবং সত্য সত্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে কালবিলম্ব না করে পেঁয়াজের এই মজুদদারদের আড়তে হানা দিতে হবে।

দুর্নীতি কি শুধু মাত্র ক্যাসিনোতেই রয়েছে? বালিশ এবং পর্দাকান্ডে কি দুর্নীতি নাই? কিছুদিন আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র কেনা এবং তা ভবনে উঠানো নিয়ে দুর্নীতির খবর প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পরবর্তী সময়ে মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। এখানে মোট খরচ হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। এই প্রকল্পে শুধু বালিশই কেনা হয়েছে ৩৩০টি, যাতে প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৫৯৫৭ টাকা। আর ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ হয়েছে ৯৩১ টাকা। তাতে কেবল বালিশের পেছনে খরচ হয়েছে মোট ২ কোটি ২৭ লাখ ৩ হাজার ৪০ টাকা। এই বালিশকান্ড আবার চাপা পড়েছে পর্দার নিচে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে রোগীকে আড়াল করার একসেট পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা, বøাড প্রেসার মাপার একটি ডিজিটাল মেশিনের দাম ১০ লাখ টাকা, স্টেথোস্কোপের দাম ১ লাখ ১২ হাজার টাকা, অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকাসহ অবিশ্বাস্য সব দামে মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জামাদি কিনেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনার ফাঁকেই খবর বেরিয়েছে, সাড়ে ৫ হাজার টাকার একটি বই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়।

রূপপুরে বালিশের দাম প্রায় ৬০০০ টাকা শুনে আমরা যারা অবাক হয়েছিলাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো আরো বড় বিস্ময়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কেনাকাটার জন্য একটি কোটেশন মিডিয়ায় এসেছে। সেখানে একটি বালিশের কভারের দাম ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। সেই তালিকায় একটি সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক ৮৪ হাজার টাকা, নির্ধারিত সাইজের একটি রেক্সিন ৮৪ হাজার টাকায় কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। খুব সাধারণ কান্ডজ্ঞান বলে, একটা সরকারের প্রতিটি স্তর দুর্নীতিগ্রস্ত না হলে এসব হতে পারে না। বালিশ, পর্দা এবং মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনায় যে পুকুর চুরি হয়েছে সেটার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেটা দেশবাসি এখনো জানে না। যারা চুরি চামারি করেছে তাদেরকে শুধু মাত্র বদলি করলে, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেই উপযুক্ত শাস্তি হয় না। এদেরকে ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে এদের বিচার হওয়ার দরকার এবং বিচারে গুরু দন্ড প্রদান করা উচিত। এছাড়া বাজারে যা নায্য দাম আছে সেই দাম রেখে অবশিষ্ট টাকা, যেটা ওরা ঘুষ হিসাবে খেয়েছে অথবা লোপাট করেছে, সেই অর্থ এদের কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় আদায় করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হলে এদের বাড়িঘর ক্রোক করে নিলামে বিক্রি করতে হবে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তবেই কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সব ভয়াবহ অপরাধের কোনো শাস্তি না দিয়ে শুধুমাত্র ক্যাসিনোর মধ্যে অভিযান সীমাবদ্ধ রাখলে অন্য ধরণের চোর বাটপাড় এবং ঘুষখোররা দিব্যি পার পেয়ে যাবে।

সুশাসন বলুন আর দুর্নীতি দমন বলুন, সেটা যদি করতে হয় তাহলে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যয় অবিশ্বাস্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে কিভাবে? সরকার চার লেন সহ বিভিন্ন মহাসড়ক নির্মাণ করছে। দেখা যাচ্ছে যে, ৪ লেনের প্রতি কিলোমিটার মহাসড়কের ব্যয় ভারতে ১০ কোটি টাকা, চীনে ১৩ কোটি টাকা, ইউরোপে ২৮ কোটি টাকা। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়কের কিলোমিটার প্রতি ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ৯৫ কোটি টাকা, পরবর্তীকালে এটা বেড়ে হয় ১২৪ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ এর কিলোমিটার প্রতি ব্যয় এসে দাঁড়িয়েছে ১৮৩ কোটি টাকায়। এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৫৫ কিলোমিটার যা নির্মাণে ভারত/চীনে ব্যয় হবে ৫৫০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা আর ইউরোপে ব্যয় হবে ১৫৪০ কোটি টাকা। আমাদের দেশে এই ৫৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।

রেল লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেখানে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন ব্যয় ভারত/চীনে ১২ কোটি টাকা, ইউরোপ/আমেরিকায় ৩০-৩২ কোটি টাকা, সেখানে ঢাকা-পায়রা রেলপথ তৈরির কিলোমিটার প্রতি খরচ ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা-পায়রা রেলপথের দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার যার অর্থ দাঁড়ায়, যে সড়ক নির্মাণে ভারত/চীনে ব্যয় হবে ২৮৮০ কোটি টাকা, ইউরোপ/ আমেরিকায় ব্যয় হবে ৭৬৮০ কোটি টাকা তা বাংলাদেশে নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য সব প্রকল্পের মতোই এই প্রকল্পের সময় এবং ব্যয় দুটোই বাড়বে তা হলফ করেই বলা যায়।
দুর্নীতি দমন বলুন আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা বলুন, একটি কলামে এসব কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না। কেউ কেউ বলতে চান যে, এই সব দুর্নীতি দমনে সরকারের আন্তরিকতা আছে। আমরা সেটা অবিশ্বাস করতে চাই না। তবে সরকার যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে তাকে হাত দিতে হবে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা চুরি, ডেস্টিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ- এসব পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরিতেও সরকারকে হাত দিতে হবে। শুধুমাত্র শেয়ার বাজারেই লক্ষ কোটি টাকার ওপর লুটপাট হয়েছে। আজও শেয়ার বাজারকে স্থিতিশীল করা যায়নি। শত শত লোক শেয়ার বাজারে লগ্নি করে মাত্র ৪/৫ জন টাইকুনের জন্য সর্বস্বান্ত হয়েছে। ঐসব সর্বস্বান্ত লোককে যেমন পুনর্বাসন করতে হবে তেমনি টাইকুনদেরকেও কাঠগড়ায় তুলতে হবে।
Email: journalist 15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jack ali ১২ নভেম্বর, ২০১৯, ৪:০৪ পিএম says : 0
We didn't liberated our country from pakistan for these people who is committing crime with the help of Top of the Government..........
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন