বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংসদে জানিয়েছেন, দেশে ৭৯০টি পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, নিরাপত্তাবিষয়ক অ্যাকোর্ড ও অ্যালায়েন্সের সুপারিশে ৩৯টি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আংশিক উৎপাদন বন্ধ রয়েছে ৪২টি কারখানার। তিনি সংসদকে জানিয়েছেন, দেশে রফতানিমুখী ৪,৮৩৪টি পোশাক শিল্পসহ ৫,১৯০টি কারখানা ছিল। অ্যালায়েন্স ও অ্যাকোর্ড ৩,৭৪৬টি কারখানায় নিরাপত্তাবিষয়ক পরিদর্শন করেছে। অন্য প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী জানিয়েছেন, আমরা ২৮টি ইউরোপিয়ান দেশের বাইরেও ৫২টি দেশে ডিউটি ফ্রি সুবিধা লাভ করছি। মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন, পোশাক শিল্পের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করছি। এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মতে, ২০১৫ সালে মিয়ানমারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা ৮.৬ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বছর মিয়ানমারে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৮.৪ শতাংশ হবে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশা করছে, যা এশিয়া প্রশান্ত অঞ্চলে দ্রুততম। সেখানকার সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে ঘোষণা করেছে যে, ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কয়েক মাসের জন্য সরকারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে ১০০ দিনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। তন্মধ্যে সদা পরিবর্তনশীল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মিয়ানমারে নয়া সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার জোরদার, দেশীয় অর্থনৈতিক বেসরকারীকরণ বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্প উৎসাহিতকরণ এবং গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্র্য দূরীকরণে কৃষি বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান সুনির্দিষ্ট। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিশালত্বের কথা সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। দিন দিন এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। কে কোন কারণে কিভাবে এসব পোশাক শিল্প বন্ধ রেখেছে বা বন্ধ রয়েছে সে প্রশ্ন বড় করে দেখার আগে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এসব শিল্প বন্ধ থাকায় ক্ষতি হচ্ছে কাদের। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি দেশের ক্ষতি। এটাও নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, পোশাক শিল্পের সাথে কেবলমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরই সম্পর্ক নয় বরং অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানেরও বড় ধরনের বিষয় জড়িত রয়েছে। মিয়ানমার আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। দেশটির অর্থনীতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহল যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন আমাদের বেলায় কিন্তু অবস্থা সেরূপ নয় বরং সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রবৃদ্ধি নিয়ে যত কথা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহল তার সাথে সুনির্দিষ্ট পার্থক্যের কথা উল্লেখ করছেন। এর কারণও তারা সুনির্দিষ্ট করেছেন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল সুনির্দিষ্ট করেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। এটা সকলেই স্বীকার করেন বিনিয়োগ বাস্তবতার সাথে আস্থা-বিশ্বাসের মৌলিক সম্পর্ক রয়েছে। অবকাঠামো বিনিয়োগের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তবে এর অবস্থান স্থিতিশীলতার ওপর নয়। মিয়ানমার সরকার অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পাশাপাশি আঞ্চলিক সংযোগে সাহায্য করতে অবকাঠামো নির্মাণ দ্রুততর করবে, অন্যদিকে মূল্য স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। বিদেশী বিনিয়োগের ঝুঁকি হ্রাস, বলিষ্ঠ বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিল্প কাঠামোর রূপান্তর ঘটানোর সুবিধার জন্য বিদেশী পুঁজি ও পুঁজির পূর্ণ সুবিধা কাজে লাগাতে চাচ্ছে। একথাও বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশটির সাথে বহির্বিশ্বের সম্পর্কও মধুর। বিশেষ করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ যারা কার্যত আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের প্রতিপক্ষ তারাও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশিত নানা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ মূলত এক গোলকধাঁধার মধ্যেই রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ বলতে গেলে নেই। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বাদ দিলে দেশে প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন বলতে কিছু নেই। বিশ্বব্যাংক থেকে এবং বিশেষজ্ঞরা বারবার বাংলদেশকে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য শ্রেষ্ঠ স্থান উল্লেখ করলেও সাথে সাথে একথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, পুঁজি বসে থাকে না। যেখানে সুবিধা পায় সেখানেই চলে যায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কোনো লুকোছাপার বিষয় নয়। এটা প্রত্যক্ষ করা যায়। দেশের সার্বিক চিত্র অত্যন্ত করুণ। সংশ্লিষ্টরা যা-ই বলুন সম্পদের কোনো সুষম বণ্টন নেই। অর্থনীতি ক্রমশ মুখ থুবড়ে পড়ছে। অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা পুঁজি ভেঙে, নাগরিকরা সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে শেষ করছে। দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। কোটি কোটি মানুষ খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছে। চোরাচালানি গেড়ে বসছে। বিনিয়োগের খরার কারণে কর্মবিনিয়োগে এক ধরনের মারাত্মক বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে, যা চলছে এতে হয়তো কোনো কোনো মহলের আত্মতৃপ্তির কারণ থাকতে পারে সেকথা ভিন্ন। মূলত দেশের অবস্থা যে ভালো নেই সেকথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক এবং জাতীয় স্থিতিশীলতার সূত্র ধরে মিয়ানমার দিন দিন যেখানে উঠে যাচ্ছে তা যে কার্যত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এমন আশঙ্কাও হয়তো অমূলক নয়। এটা বোঝা দরকার, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়াতেই মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে, যা দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বের অনেক দেশের সাথেই সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে বা হবার পথে। এর মূল কারণ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাস্তবভিত্তিক নীতির কোনো বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাধাসমূহ দূর করতে খোলা চোখে দেখতে হবে। প্রতিবার বাজেট ঘোষণায় যেসব উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা শোনা যায় বছরান্তে দেখা যায়, হয়তো তার অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ে বৈ কমে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র কেউ তুলে ধরলেই সংশ্লিষ্টরা নানা কথা বলেন। অথচ বাস্তবে অর্জন কতটা তা কিন্তু বলেন না। টিকে থাকার জন্যই শক্তিশালী অর্থনীতি প্রয়োজন। আর তা অর্জন করতে হলে অবশ্যই আস্থার বাতাবরণ তৈরি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলে এ ব্যাপারে আন্তরিক হবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন