মানুষ সামাজিক জীব। কোনো মানুষই পৃথিবীতে একা বসবাস করতে পারে না। পরিবার নিয়ে সমাজ গঠিত হয়। সমাজ রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম অংশ। মানুষ যেমন একা চলতে পারে না, তেমনি সমাজও এমনি এমনি চলতে পারে না। সমাজ পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন একদল পরিচালকের। সমাজকে তার স্ট্যাটাস অনুযায়ী গঠন, পরিচালনা ও নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পরিচালকরা সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সমাজ জীবন আছে বলেই আমরা একে অপরকে সম্মানের চোখে দেখি, একজন অন্যজনের সুখে-দুঃখে পাশে থাকি। অর্থাৎ সমাজ মানেই পারস্পারিক ¯েœহ ভালবাসা আর সৌহার্দ্য-সহযোগিতার এক সুদৃঢ় বন্ধন।
সমাজের অধঃপতন ও বিপদের সময় দেখা যায়, আমরা কত শ্রেণির মানুষ একটা সমাজকে নিয়ে ভাবি। একটি ভংগুর সমাজকে টেনে তুলতে কতগুলো মানুষের চিন্তা, কর্ম, আর সহযোগিতা প্রয়োজন হয়? স্বাভাবিকভাবে দেখলে মনে হবে। আমাদের চলার পথে সমাজের কোন অবদান নেই। কিন্তু মূল বিষয় হলো, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে সমাজ ও সামাজিক প্রক্রিয়ার নানা অবদান। উদহরণসরূপ বলা যায়, যখন আমাদের সমাজে কোন বিপর্যয় নেমে আসে বিশেষ করে মহামারি, অগ্নিকান্ড বা খরা, বন্যা জলোচ্ছ্বাসের মত কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তখন আমাদের চারপাশ থেকে সহযোগিতার অসংখ্যা হাত বেরিয়ে যায় নানা সংগঠনের নামে। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাদের কাজ করতে দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকা-, ভবন ধস, জাহাজ ডুবিতে এর যথেষ্ট প্রমাণ আমরা দেখেছি। অর্থাৎ আমাদের জীবন পরিচালনা করার পথে যেমন পরিবারের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি সমাজের নানা ধরনের সংগঠনের ভূমিকাও রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে।
সমাজকে প্রত্যাশিত মানে নিয়ে যেতে হলে আমাদের এই সকল সংগঠনকে আরো কার্যকর ও গতিশীল করে তোলা প্রয়োজন। দল-মত, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দূর করে সমাজকে গতিশীল ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য হিসাবে তৈরি করতে বদ্ধ পরিকর হতে হবে।
সামাজিক সংগঠনের রূপরেখা বিভিন্ন হতে পারে। তবে লক্ষ্য হওয়া চাই একটি। সামাজিক সংগঠনের কাছে প্রতিটি নাগরিকের কিছু প্রাপ্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজের প্রতিটি মানুষের রুচি, চাহিদা, প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যেও রুচি, চাহিদা ও নীতিমালার ভিন্নতা থাকা জরুরি। সাধারণত আমাদের সমাজে পরিবেশবাদী, স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক, শিক্ষা ও শরীর চর্চা বিষয়ক নানা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এর বাইরে যৌতুক, মাদক ও নারী নির্যাতন বিরোধী সংগঠনও রয়েছে অসংখ্য। এই সকল সংগঠনের মাধ্যমে সমাজ থেকে নানা অসংগতি ও অন্যায় কর্ম কমে আসছে অনেকাংশে। একটি স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের কাছে নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা কী হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে কোন সংগঠন কী বলবে সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং কোন সংগঠন আমাদের কী দিতে পারবে সেটিই বড় কথা। আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাঙালি কালচার ও আদর্শের আলোকে গড়তে হলে আমাদের বহুমুখী সংগঠনের কোন বিকল্প নেই। যে সংগঠনগুলোর কাজ হতে পারে নি¤েœাক্ত:
নতুন প্রজন্মকে বই পড়াতে আগ্রহী করতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে বইয়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের আসক্তি কমছে প্রচুর পরিমাণে। সে জন্য প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যেখানে শিশু কিশোর থেকে শুরু করে যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবার জন্য সকল ধরনের বইয়ের একটি সমারোহ থাকবে। শিক্ষনীয় গল্প নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি বই পাঠের অভ্যাস হতে পারে সকলের জন্য নতুন সঙ্গী। পাশাপাশি বই বিক্রয় ও বিলিকেন্দ্র স্থাপন করে সমাজের সর্বত্র জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে সবাইকে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মাদক, ইভটিজিং, যৌতুক, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের মতো গর্হিত এবং অন্যায় কাজ থেকে আমাদের যুব সমাজকে রক্ষা করতে হলে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নাই। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে শুধু র্যালি বা প্রতিবাদ করেই শেষ নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগুলোর কুফল সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে নয়, সাপ্তাহিক বা মাসিক আলোচনা, সভা, সেমিনারের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে সামাজিক অসংগতিগুলো।
অগ্নিকা-, ভবন ধস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। আবার এগুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা থাকে অনেক বেশি। সুতরাং সমাজের প্রতিটি নাগরিককে বেসামরিক প্রশিক্ষণ এর আওতায় আনার মাধ্যমে তাদেরকে নানা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার যোগ্যতা অর্জনের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। নৈতিক অবক্ষয় রোধে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে তথ্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কিত নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে।
কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদের জ্ঞান ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে জ্ঞানমূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। সেই সাথে শরীর-মন সুস্থ রাখতে খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা দরকার। বর্তমান সমাজে অনেক সময়ে দেখা যায়, সামাজিকভাবে ভালো মানের কোনো খেলাধুলা বা প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রম না থাকার কারণে অনেকেই অবসর সময়ে অসৎ সঙ্গ গ্রহণ করে থাকে। সামাজিক সংগঠনের নানামুখী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ছেলে-মেয়েদের এই অসৎ সঙ্গ থেকে ফেরানো দরকার।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারে এ সকল সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ডেঙ্গুসহ যে সমস্ত কারণে আমাদের সমাজ মহামারীতে আক্রান্ত হচ্ছে এ সকল বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলে সমাজকে রক্ষা করার উদ্যোগ সকলের কাম্য।
নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত রাখতে এ সকল সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন দিবসের আলোচনা সভা ও শিক্ষনীয় গল্পের আয়োজন করা একান্ত প্রয়োজন, যাতে করে তারা মুক্তি যুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।
এক কথায় বলতে গেলে আমাদের সমাজ শুধুমাত্র সমাজ নয়, এটা একজন মানুষের জন্য বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ তার কর্ম ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করে। সুতরাং সমাজে বসবাসকারী সকল নাগরিকের সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত এবং তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও যথাযথভাবে সমাজ পরিচালনা করার জন্য আমাদের প্রত্যেকটি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে কাঠামোগত ও যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন