রাজধানীবাসীর দুর্ভোগ লাঘবের যত কথা যতই বলা হোক না কেন, কার্যত নতুন নতুন সমস্যা নগরজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। প্রতিবছরই রমজানের শুরুতে রাজধানীজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। এবারে এ দৃশ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এর উপর রয়েছে মিছিল-মিটিং ও ধর্মঘটের মতো দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মসূচী। সেদিন ১৪ দলের মানববন্ধনে সৃষ্ট জটের রেশ কাটতে না কাটতেই পরিবহন সেক্টরে একটি অফিস দখলকে কেন্দ্র করে চলেছে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। দখলকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার দুপুরে সৃষ্ট সংঘর্ষের কারণে প্রায় তিনঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শাজাহান খান গ্রুপ রোববার সন্ধ্যার পর টিকাটুলির অফিস দখল করে নিলে বেলা ১২টার দিকে দুই গ্রুপ মুখোমুখি হলে সংঘর্ষ বাঁধে। এর জের ধরে বেলা পৌনে একটার দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে গত সোমবার অফিস দখলের প্রতিবাদে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটে প্রায় ১০ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘটে অচল ছিল দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল। ফলে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই সাথে ঢাকার বাইরে থেকেও কোন বাস ঢাকার উদ্দেশে ছাড়েনি। ফলে সকাল থেকে হাজার হাজার যাত্রীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বিকাল সাড়ে চারটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের মানসিকতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাদের সংগঠনগুলো যে প্রকৃতপক্ষে চাঁদাবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে সে কথাও নতুন কিছু নয়। এবারের ধর্মঘটের নেপথ্যেও সেকথাই উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সমর্থিত ঢাকা জেলা শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকারি দলের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা সমর্থিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পরিবহন কার্যালয়ের দখল এবং চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধ চলছে। গুলিস্তান কার্যালয়টি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের দখলে ছিল। রোববার হঠাৎ করেই কার্যালয়টি দখল করে নেয় প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ। আর তাদের এই বিরোধের কারণেই ধর্মঘট ডাকা হয়। সরকার দলীয়দের চাঁদা ভাগাভাগির জেরে জিম্মি হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। একদিকে শহরের ভেতরে যাতায়াতকারীদেরও যেমনি চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে তেমনি বাইরের যাত্রীদেরও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। অনেককে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়েছে। হাজার হাজার যাত্রীকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে কাকডাকা ভোর থেকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেকের সাথেই ছিল পুরো পরিবার। কারো কারো সাথে ছিল ভারী ব্যাগ। যারা সাধারণত এসব অঞ্চল থেকে এসে ঢাকায় অফিস করেন এই রমজানে তাদেরকেও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই পরিস্থিতি কোন রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি হয়নি। এর আগে রাজনৈতিক কর্মসূচী দমনে খোদ নৌপরিবহনমন্ত্রী সারাদেশে অঘোষিত ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেছিলেন। এবার তার নেতৃত্বাধীন শ্রমিক সংগঠনের চাঁদাবাজি কেন্দ্র করে ধর্মঘট ডেকে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনিতেই রোজার দিনে যেখানে রোজাদারদের সুবিধার্থে সদয় হওয়া বাঞ্ছনীয় সেখানে ঘটছে তার বিপরীত। এই অবস্থা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।
পরিবহনজনিত নাগরিক দুর্ভোগে এমনিই নগরবাসী নাকাল। খোঁড়াখুঁড়ি করা সড়ক, দখলকৃত সড়ক ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা সব মিলে সংকটের কোন অন্ত নেই। বারবার লেখালেখি সত্ত্বেও এসবের কোন সমাধান হয়েছে বা হবে সেরকম মনে করার কোন কারণ নেই। তার উপর টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দুই শ্রমিকদলের বিরোধে ধর্মঘট এমন এক সময়ে দেখা দিল যখন সামনে পবিত্র ঈদুল-ফিতর। দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্টদের আশ্বাসের ভিত্তিকে সমস্যার আপাত সমাধান হলেও কার্যকর কোন সমাধান হয়েছে তা বলা যাবে না। সারাদেশে অবৈধ অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে যে ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে এটিও তার থেকে আলাদা কিছু নয়। যাইহোক না কেন নিজেদের মধ্যে বিরোধের জের ধরে সাধারণ জনগণ দুর্ভোগে পড়বে সেটি কোনমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ও অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি যাতে পুনরায় না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টরা যতœবান হবেন বলেও আমরা মনে করি। রমজান ঈদকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের পথচলা যাতে নির্বিঘœ হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলে যতœবান থাকবেনÑ এটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন