একটা সময় ট্রেনকে সবচেয়ে নিরাপদ যাতায়াতের অবলম্বন মনে করা হলেও বর্তমানে যাত্রী সাধারণের কাছে ট্রেন এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে যাত্রাপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু নতুন কোনো বিষয় নয়! দেশের সড়কপথে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। যাতায়াতের জন্য সড়কের চেয়ে রেলপথকে অধিক নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু থেমে নেই। ট্রেন চালক ও পয়েন্টম্যানের সিগন্যালের ভুল, লক্কর-ঝক্কর রেলপথ ও রেল সেতু এবং মেয়াদোতীর্ণ রেলওয়ে ইঞ্জিনের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেশের কোনো না কোনো রেলপথে ঘটছে দুর্ঘটনা। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেল দুর্ঘটনায় অন্তত সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছে অগণিত মানুষ। এর শেষ কোথায়? এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই কারো কাছে! তবে ট্রেন দুর্ঘটনা এড়াতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনটি বিষয়। এগুলো হলো, দেশের সকল রেলপথে ডাবল লাইন নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ লেবেল ক্রসিংগুলোতে লোকবল নিয়োগ এবং ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের আরো সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন।
তবে বেসরকারি সংগঠন নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির পর্যবেক্ষণে রেলওয়ের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পেছনে ছয়টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, রেলওয়ের অনুমতি ছাড়াই অপরিকল্পিত ও অবৈধ লেবেল ক্রসিং নির্মাণ, রেলপথ ক্রসিংগুলোর কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে চরম উদাসীনতা, কিছুসংখ্যক রেলসেতুসহ অনেক স্থানে রেলপথ দীর্ঘদিন সংস্কার না করা এবং দূরপাল্লার ট্রেনগুলোর চালকদের অসতর্কতা ও দায়িত্ব পালনে অদক্ষতা।
ট্রেন দুর্ঘটনার রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন আউটারে। দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান নারী-পুরুষ-শিশুসহ মোট ১শ’ ৭০ জন। আহত হয় চার শতাধিক মানুষ।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান মতে, স্বাধীনতার পর দেশে প্রথম রেল দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালের ২ জুন। এদিন যশোরে ট্রেন দুর্ঘটনায় ৭৬ যাত্রী মারা যায় আর আহত হয় ৫শ’ জন যাত্রী। ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ৭০ যাত্রী মারা যায় এবং আহত হয় ৩শ’ যাত্রী। ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীতে একটি রেল সেতু ভেঙে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৬০ যাত্রী। আহত হয় দেড় শতাধিক। ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুর গামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের বগিতে আগুন লেগে জীবন্ত পুড়ে মারা যান ২৭ জন যাত্রী আর আহত হয় আরো ২৭ জন। ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ সর্বহারার নাশকতায় ভেড়ামারায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে যায়। এতে প্রাণ হারায় ২৫ যাত্রী আর আহত হয় ৪৫ জন। ১৯৮৯ সালের ২ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রামে যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নিহত হয় ১৩ জন আর আহত হয় ২শ’ জন। ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি দিনাজপুর হিলি রেলওয়ে স্টেশনে গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেন ও সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস-এর ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ৫০ যাত্রী। আহত হয় দুই শতাধিক। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন প্রাণ হারায় আর আহত হয় শতাধিক। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২৪ জন প্রাণ হারায় আর আহত হয় দেড় শতাধিক। ২০১০ সালে নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ‘মহানগর গোধূলি’ ও ঢাকাগামী মেইল ‘চট্টলা’ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে চট্টলার চালকসহ ১২ জন নিহত হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। ২০১৬ সালে নরসিংদীর আরশীনগরে যাত্রীবাহী ট্রেন তিতাস কমিউটারের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হলে দুইজন নিহত হয় আর আহত হয় ১০ জন। ট্রেনটি ঢাকা থেকে ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছিল। ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনট্যুত হয়ে ৫ জন নিহত হয় আর আহত হয় ৪৫ জন। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালেরই ২৩ জুন মৌলভীবাজার জেলার বরমচালে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৬ জন আর আহত হয় ৪০ জন। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ভোররাত পৌনে ৩টার দিকে উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস এক নম্বর লাইনে ঢুকছিল। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ত‚র্ণা নিশীথাকে আউটারে থাকার সিগন্যাল দেয়া হয়। চালক সিগন্যাল অমান্য করে মূল লাইনে ঢুকে পড়লে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারায় ১৬ জন। আহত হয় কমপক্ষে ৭৬ জন যাত্রী। এ দুর্ঘটনায় ছোট্ট শিশু সোহার লাশ দেখে কেঁদেছে পুরো দেশবাসী। আর গুরুতর আহত ছোট্ট শিশু নাঈমাকে দেখে বেদনায় মুষড়ে যাবার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় যাত্রীবাহী ‘রংপুর এক্সপ্রেস’র পাওয়ার কারে আগুন ও তিনটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ওই ট্রেনটির চালকসহ ১০ জন আহত হয়।
দেশে ট্রেন দুর্ঘটনার ব্যাপারে ২০১৮ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক জাতীয় সংসদে ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন। তাঁর দেয়া তথ্যমতে, ওই ৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ২০৩ জন যাত্রী আর আহত হয় ৫শ’ ৮৬ জন। তিনি জাতীয় সংসদে জানান, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৯৩টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮শ’ ৬৪ টাকা। সমগ্র বাংলাদেশে রেলওয়েতে লাইনচ্যুতিসহ মেইন লাইন ও শাখা লাইনে ২০০৯-১০ সালে ৩শ’ ৮টি, ২০১০-১১ সালে ২শ’ ২৪টি, ২০১১-১২ সালে ১শ’ ৮২টি, ২০১২-১৩ সালে ১শ’ ৭৬টি এবং ২০১৩-১৪ সালে ২শ’ ৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১শ’ ৫২ জন এবং আহত হয়েছেন ৩শ’ ৮৬ জন। আর দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮শ’ ৬৪ টাকা।
ডবিøউবিবি ট্রাস্টের গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে সারাদেশে দুই হাজার ৯২৯ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। এর মধ্যে মানস¤পন্ন রেললাইন রয়েছে মাত্র ৭৩৯ কিলোমিটার, যা মোট রেললাইনের মাত্র ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। ঘন-ঘন ট্রেন দুর্ঘটনার যতগুলো কারণ রয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রেললাইনে ত্রæটি, সিগনাল অমান্য করা বা সিগনালিং ত্রæটি, ঝুঁকিপূর্ণ রেল ক্রসিং (দেশে ২ হাজার ৩১টি ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং রয়েছে। সেসব স্থানে কোনও গেটকিপার নেই), ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজন, রেললাইনে পাথরের স্বল্পতা, নড়বড়ে ট্র্যাক, ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু (দেশে বর্তমানে রেলপথে ছোট-বড় তিন হাজার ১৪৩টি কালভার্ট ব্রিজ রয়েছে। এরমধ্যে ৩২৬টি বড় সেতু ও দুই হাজার ৮১৭টি ছোট সেতু রয়েছে। এর অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলের। সেতুগুলো সংস্কার না করায় এরইমধ্যে ৪০২টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে মাঝে মধ্যে ব্রিজ ভেঙে, কিংবা ¯ি¬পার না থাকায় লাইনচ্যুত হয়ে রেল দুর্ঘটনা হচ্ছে), আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, লোকবল সংকট ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমাদের দেশে নানা কারণে ট্রেনের দুর্ঘটনা ঘটে। প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের রেল সেই সক্ষমতা অর্জন করেনি। এ জন্য কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছাও নেই। দুর্ঘটনা রোধে রেল কর্তৃপক্ষ রেলের গতি কমানো ও উদ্ধার কাজে ব্যবহারের জন্য ক্রেনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ধরণের মান্ধাতা আমলের চিন্তা থেকে রেলকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এছাড়া রেলওয়ে পুলিশ ও আনসার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, রেলওয়ে হাসপাতাল ও ডাক্তারদের এ ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলায় সক্রিয় করা, রেললাইনের স্লিপার আটকানোর ক্ষেত্রে যে বাঁশনির্ভরতার সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রæত বন্ধ করা, সারাদেশের পুরাতন জরাজীর্ণ রেলব্রিজ ও রেলপথ পুননির্মাণ এবং সংস্কার করে একটি নিরাপদ-জনবান্ধব সাশ্রয়ী রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে রেল দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এ ব্যাপারে রেলওয়ের বক্তব্য হলো দুর্ঘটনা রোধে রেলওয়ের অনেক বিধিবিধান রয়েছে। তাতে কোন সময়, কী করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সেই বিধিবিধানগুলো মানা হয় না বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। যথাযথভাবে বিধিবিধানগুলো মানা হলে আর দুর্ঘটনা ঘটবে না।
যে যাই বলুক না কেন, এখন সরকার ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের প্রথম এবং একমাত্র কাজ হলো রেল দুর্ঘটনার কারণগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে রেল দুর্ঘটনা রোধ এবং জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রেলকে পুনরায় নিরাপদ যাতায়াতায়ের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে যাত্রী সাধারণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা। আর এটি করতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত সাপেক্ষে রেলকে ঢেলে সাজানো।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন