বিজিএমইএ ও ডেইলি স্টারের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তরা বলেছেন, তৈরি পোশাক রফতানি করে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ আয়লক্ষ্য ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব, তবে চ্যালেজিং। স্মরণ করা যেতে পারে, এই আয়লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ। এর আগে সংগঠনের সভাপতি বলেছিলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনো স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের পরিকল্পনা। এ শিল্পে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, তাকে কাজে লাগাতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। বলার অপেক্ষা রাখে না, পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও মালিকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা যেমন আছে, তেমনি আছে দক্ষ-অভিজ্ঞ-প্রশিক্ষিত জনবল, বিপুল বিনিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা। এগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে নির্ধারিত আয়লক্ষ্য তো বটেই, এমনকি তার বেশীও অর্জন করা সম্ভবপর হতে পারে। অবশ্য বলা যত সহজ কাজটি তত সহজ নয়। আয়লক্ষ্য অর্জনের অপরিহার্য কিছু পূর্বশর্তও আছে, যা পূরণ না হলে আশাবাদ বাস্তবায়িত হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্টই। ২০২১ সাল নাগাদ যে আয়লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে তার অর্ধেকের কিছু বেশী অর্জিত হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয় প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত করতে হবে। তা করতে হলে প্রতি বছর অন্তত অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার করে রফতানি আয় বাড়াতে হবে। এ জন্য রফতানিও বাড়াতে হবে। বিদ্যমান বাজারগুলোতে রফতানি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন বাজার সন্ধান করে রফতানি নিশ্চিত করতে হবে। রফতানি ও রফতানি আয় বাড়াতে হলে উৎপাদনও বাড়াতে হবে এবং সে জন্য এই খাতে নতুন বিনিয়োগও আনতে হবে। সঙ্গতকারণেই এ খাতের প্রতি সর্বোচ্চ নজর ও গুরুত্ব দিতে হবে যদি আয়লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করতে হয়।
দেশের শিল্পখাতগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পখাতের অবস্থান শীর্ষে। সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ হয়েছে এ খাতে, সবচেয়ে বেশী কর্মসংস্থান হয়েছে এখাতে এবং সবচেয়ে বেশী রফতানি আয়ও আসে এখাত থেকে। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এখাতে ৫০ লাখের মতো মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে আরো অন্তত ৫০ লাখ লোকযুক্ত। দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮১ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। বলা যায়, তৈরি পোশাকের রফতানি বাড়লে, আয় বাড়লে দেশের মোট রফতানি ও রফতানি আরও বাড়বে। তৈরি পোশাক খাত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে তার অবস্থান, গুরুত্ব ও অবদানের কারণেই। এটা কারো অজানা নেই, দীর্ঘদিন ধরেই এ খাত নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এ তথ্যও রয়েছে, রফতানি বাড়ার যতটা সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে তা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। শতশত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনা, শ্রমিক অসন্তোষ, আমদানিকারক দেশগুলোর নানামুখী শর্ত, যুক্তরাষ্ট্রে জেএসপি সুবিধা না পাওয়া। প্রতিযোগী নতুন নতুন দেশের আবির্ভাবসহ বিভিন্ন কারণে তৈরি পোশাক খাত একটা কঠিন সময় পার করছে। অন্যদিকে এখাতে নতুন বিনিয়োগও আসছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, জমি প্রাপ্তির জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক টালবাহানা ইত্যাদি কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিগত বছরগুলোতে বিজিএমইএ’র কর্মকর্তারা রাজনীতি ও সরকার তোষণে মগ্ন থেকেছেন। শিল্পের সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নে যেমন তারা নজর দেননি রফতানি বাড়াতেও উদ্যোগী ভূমিকা রাখেননি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আয়লক্ষ্য অর্জন স্বপ্ন ও কথামালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে।
আমরা বিশ্বাস করি না, শিল্পে যে সব সমস্যা বিদ্যমান তার সমাধান অসম্ভব। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সম্ভব। জমির সমস্যার সমাধান করাও সম্ভব। ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদ হার কমানো কঠিন কিছু নয়। বিনিয়োগ, উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে এ সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে কারখানার পরিবেশ, নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার বিষয়ে আমদানিকারক দেশগুলোর যে সব শর্ত রয়েছে, সেগুলো পূরণেও তৎপর থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। বলা আবশ্যক, সারা বিশ্বে তৈরি পোশাকের একটি ক্ষুদ্রাংশই সরবরাহ করে বাংলাদেশ। রফতানি বাড়ানোর অপার সম্ভাবনা তার সমানে অবারিত রয়েছে। জাতীয় বৃহত্তর সার্থেই রফতানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। যে লক্ষ্যমাত্রা বিজিএমইএ নির্ধারণ করেছে তা অর্জন যেহেতু সম্ভবপর সুতরাং দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিয়ে তা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএকে আরো সক্রিয় হতে হবে। সরকারকেও কাক্সিক্ষত সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, প্রতিজ্ঞা, উদ্যোগ, সহযোগিতা যতই থাক, লক্ষ্য অর্জন অনিশ্চিত ও অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে যদি দেশে উপযুক্ত পরিবেশ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকে। এই পূর্বশর্তটি সবার আগে পূরণ করতে হবে। দেশে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার আশংকা রয়েছে, তা দূর করার জন্য সরকারকে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন